সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিআরটিসির ডিপো নষ্ট গাড়ির ভাগাড়

শিমুল মাহমুদ

বিআরটিসির ডিপো নষ্ট গাড়ির ভাগাড়

বিআরটিসির ডিপোতে বিপুলসংখ্যক নষ্ট গাড়ি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

সরকারি পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন-বিআরটিসির অধিকাংশ ডিপো নষ্ট গাড়ির ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। বিআরটিসির ২২টি ডিপোর অধিকাংশই মেরামত অযোগ্য পরিত্যক্ত গাড়ির কারণে অবরুদ্ধ হয়ে আছে। দুর্নীতি অনিয়মের মাধ্যমে কেনা এসব বাস ঘোষিত লাইফ টাইমের এক-তৃতীয়াংশ সময়ের মধ্যেই বিকল হয়ে পড়েছে। অবহেলা আর কার্যকর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কোনো বাস অচল হয়ে ডিপোতে গেলে সেটি আর রাস্তায় ফিরে আসে না। ফলে সরকারি এই সংস্থাটির মোট বাসের এক-তৃতীয়াংশের বেশি অচল হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত দুই দশকে বিআরটিসিতে যেসব গণপরিবহন কেনা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে ভলবো দ্বিতল বাসগুলো ছাড়া বাকি সবই  নিম্নমানের। যেগুলো অল্প সময়ের মধ্যেই লক্কড়ঝক্কড় অবস্থায় ডিপোতে ঠাঁই নিয়েছে। ভলবো বাসগুলোও কার্যকর রক্ষণাবেক্ষণ না করে নির্ধারিত লাইফ টাইমের আগেই বিকল করে ডিপোবন্দী করে ফেলা হয়। সম্প্রতি বিআরটিসি বিভিন্ন ডিপোতে অচল হয়ে থাকা গাড়িগুলোর মধ্যে ১২৯টি গাড়ি নিলামে বিক্রি করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে দোতলা ভলবো বাস, দোতলা বাস, একতলা বাস, ট্রাক, কার ও অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। জানা গেছে, অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বিপুলসংখ্যক যাত্রীবাহী বাসের বহর নিয়েও লোকসানের ঘানি টানছে বিআরটিসি। সংস্থাটির লুটপাটের পথ প্রশস্ত করতে গত কয়েক বছরে চীন, কোরিয়া ও ভারত থেকে কেনা হয়েছে একের পর এক নিম্নমানের বাস। বছর না যেতেই সেগুলো অচল হয়ে পড়ে থাকছে ডিপোতে। বাড়ছে মেরামত খরচ, গুনতে হচ্ছে লোকসান। বিআরটিসির বহরে বর্তমানে বাস রয়েছে ১ হাজার ৩৮৯টি। এর মধ্যে কমবেশি ৫২৫টিই অচল হয়ে বিভিন্ন ডিপোতে পড়ে আছে। এ হিসাবে বিআরটিসির বহরে থাকা বাসগুলোর ৩৮ শতাংশ অচল অবস্থায় রয়েছে। এসব অচল বাসের অধিকাংশই গত ১০ বছরে কেনা। সূত্র জানায়, গত এক দশকে নতুন বাস-ট্রাক কেনায় বিআরটিসির মাধ্যমে সরকার খরচ করেছে ১ হাজার ৬১২ কোটি টাকা। এই বিপুল বিনিয়োগের পরও লুটপাটে বিপর্যস্ত হয়ে আছে বিআরটিসি। সংস্থাটির আগের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। সম্প্রতি বিআরটিসিতে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি সংস্থাটিকে অনিয়মের অতল থেকে টেনে তোলার চেষ্টা করছেন। নিম্নমানের গাড়ি কেনার দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালে চীন থেকে ১২২ কোটি ৪৯ লাখ টাকায় কেনা হয় ২৭৯টি বাস। অভিযোগ রয়েছে, টাকার অঙ্ক বেশি দেখানো হলেও কম টাকায় কেনা নিম্নমানের বাসগুলোর বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে বিভিন্ন ডিপোতে পড়ে আছে। মূলত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দুই বছরের মাথায় এসব বাস নষ্ট হতে শুরু করে। এখন চলাচলের একেবারেই অযোগ্য ১৬০টি বাস। চীনের পর ২০১১-১২ অর্থবছরে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ২৮১ কোটি টাকায় কেনা হয় আরও ২৫৫টি বাস। এগুলোর বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে পড়ে আছে বিভিন্ন ডিপোতে। প্রতিটি বাসের দাম পড়ে কোটি টাকার বেশি। বিআরটিসির কারিগরি শাখার তথ্যানুযায়ী, ছয় বছর পার না হতেই ৮১ বাস নষ্ট হয়ে যায়। এগুলো এখন মেরামতের উপযোগীও নয়। ২০১৩ সালে ভারত থেকে ঋণ নিয়ে কেনা আর্টিকুলেটেডসহ ৪২৮ বাসের একটি বড় অংশ বিকল হয়ে গেছে। বিআরটিসির প্রতিটি ক্রয় চুক্তি, বাস সংগ্রহ ও রক্ষণাবেক্ষণে রয়েছে সীমাহীন অনিয়ম। এদিকে ২০১২-১৩ সালে ১০০ কোটি টাকায় ৫০টি আর্টিকুলেটেড এবং ৮৮টি এসি বাস কেনে বিআরটিসি। শুরুতে এসব বাসের আয়ু ১৫ বছরের বেশি বলা হলেও মাত্র দুই-তিন বছরের মধ্যেই বাসগুলো নষ্ট হতে থাকে। একেকটি আর্টিকুলেটেড বাসের দাম ১ কোটি ১১ লাখ টাকা। বর্তমানে ৫০টি আর্টিকুলেটেড বাসের ২০টির বেশি অচল হয়ে বিভিন্ন ডিপোতে পড়ে আছে। আরও ১৫/১৬টি বাস জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এগুলো যে কোনো সময় অচল হয়ে যেতে পারে। ৫৪ ফুট দীর্ঘ জোড়া লাগানো এসব বাস এখন কেবল রাজধানীর দুটি রুটেই চলাচল করছে। জানা গেছে, এই বাসগুলো কেনার কথা ছিল বর্তমানে নির্মাণাধীন গাজীপুর-বিমানবন্দর রুটের বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের জন্য। কিন্তু কোটি টাকার বেশি মূল্যের এসব বাস বিআরটি প্রকল্পের কাজ শুরুর অনেক আগেই কেনা হয় লুটপাটের জন্য।

এদিকে সুইডেন থেকে কেনা ৫০টি ভলবো দ্বিতল বাসের সবগুলোই বিকল হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে গাজীপুরে বিআরটিসির কেন্দ্রীয় বাস মেরামত কেন্দ্রে রয়েছে ২৩টি আর মিরপুর ডিপোতে রয়েছে ২৭টি। এসব বাসের ক্রয়মূল্য প্রায় ৫২ কোটি টাকা। ঋণের টাকায় কেনা এসব বাস না চললেও সুদসহ ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে সরকারকে। ইচ্ছাকৃত অবহেলায় এসব বাস নষ্ট করে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ১৯৯১ সালে বিআরটিসি সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির (সিডা) টাকায় ৫০টি দ্বিতল বাস কেনার প্রকল্প হাতে  নেয়। সিডা এ প্রকল্পে ৬১ কোটি টাকা অর্থায়ন করে। তবে এর মধ্যে অর্ধেক ছিল ঋণ ও বাকি অর্ধেক অনুদান। প্রতিটি বাসের জন্য তখন মূল্য ধরা হয় ১ কোটি ৩ লাখ টাকা। এ হিসাবে ৫০ বাসের মূল্য দাঁড়ায় ৫২ কোটি টাকা। বাকি ৯ কোটি টাকা রাখা ছিল বাসগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। সেই কোটি টাকার ভলবো বাসগুলোর প্রতিটি এখন মাত্র চার লাখ টাকা করে নিলামে বিক্রির চেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামসুল হক বলেন, অবহেলায় জনগণের মূল্যবান সম্পদগুলো নষ্ট করে ফেলা হলো। সরকারি ছত্রছায়ায় থাকা কিছু সুবিধাভোগী বাসগুলোকে নষ্ট করেছেন। জনগণকে সেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের টাকা পানিতে ফেলেছেন তারা। সঠিকভাবে  মেরামত করা হলে জনগণের সেবায় আরও ২৫ থেকে ৩০ বছর ভলবো বাসগুলো সার্ভিস দিতে পারত। ভলবো বাসের আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছিল ১৫ বছর। প্রতিটি বাস ছয় হাজার কিলোমিটার চালানো ও সাত লাখ ২০ হাজার যাত্রী পরিবহনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। কিন্তু ২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রতিটি বাসে বছরে যাত্রী পরিবহন করা হয় তিন লাখ ১৪ হাজার ৮০০ জন। নষ্ট হওয়ার পর সেগুলোর যন্ত্রাংশ সময়মতো লাগানো হয়নি। ফলে ব্যবহারের ৮ বছরের মধ্যেই পরিত্যক্ত ও নষ্ট হয়ে যায় বাসগুলো। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব ভলবো বাস মেরামতের জন্য বিশেষভাবে ৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও সে টাকা অন্য বাস মেরামতের নামে লোপাট করেন বিআরটিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সব মিলিয়ে বিআরটিসির রাজধানীর মিরপুর, কল্যাণপুর, জোয়ারসাহারা, মতিঝিল, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, রংপুর, বগুড়া, নরসিংদীসহ বিভিন্ন ডিপো এখন নষ্ট বাসের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।

সর্বশেষ খবর