সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

লোভেই হলো শেষ

মির্জা মেহেদী তমাল

লোভেই হলো শেষ

অফিসে বসেই চেকবইয়ে টাকার অঙ্কটা লিখলেন  সোহরাব হোসেন (ছদ্মনাম)। পাঁচ লাখ। একটু খারাপ লাগছিল তার। ভাবছিলেন রিটায়ারমেন্টের খুব বেশি বাকি নেই। সবেমাত্র ছেলেটা অনার্স পাস করল। মেয়েটা এসএসসি দেবে। পাঁচ লাখ তুলে ফেললে বাকি থাকবে দুই লাখ ৪৭ হাজার। চেকে সই করে দিলেন। পাঁচ লাখ টাকা পাঠাতে হবে। তবে পুরস্কারের মূল্যও কম নয়। ২২ লাখ টাকা। একবার ভাবলেন স্ত্রীর সঙ্গে লাপ করলে কেমন হয়! কিন্তু ওরাতো পুরস্কারের কথা গোপন রাখতে বলেছে। বহুদিন আগে কেনা নকিয়া সেটটা হাতে নিলেন। মাস শেষে বিল দেখে গ্রামীণের সিম ব্যবহার করবেন না বলে ও ভেবেছিলেন। ভাগ্যিস ছাড়েননি। লাঞ্চ ব্রেকে বাইরে গেলেন। সোজা ব্যাংকে। আজ আর লাইনে দাঁড়াতে হলো না তার। ঝটপট টাকা তোলার কাজটা হয়ে গেল। ভাবছেন সোহরাব, যাক ভাগ্যটা মনে হয় আজ ভালোই। ব্যাংক থেকে সোজা বিকাশ (মোবাইল অর্থ লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান)-এর দোকানে। পাঁচ লাখ টাকাই পাঠালেন। বেশ অনেক নম্বরে। প্রত্যেকবার টাকা গুনে দোকানদারের হাতে দিচ্ছিলেন। অনেক কষ্টে জমানো টাকা। খারাপ লাগছিল। কিন্তু সেই কণ্ঠ বারবার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। ‘আপনি দুই লাখ সেরা গ্রাহকের মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছেন। পুরস্কার হিসেবে আপনি পাবেন একটি নতুন মাইক্রোবাস অথবা ২২ লাখ টাকা নগদ।’ সোহরাব সাহেব সারাজীবনই পেছনে ছিলেন। কখনই কোনোকাজে সেরা ছিলেন না। আজ প্রথমবারের মতো সেরাদের মধ্যে সেরা। নিজের অজান্তেই গর্বে বুক ভরে যায়। আর্থিক মূল্যেও বিরাট, অন্তত সোহরাব সাহেবের কাছে। চাকরিতে সুযোগ পেয়েও তিনি নীতিভ্রষ্ট হননি। সারাজীবন সৎ থাকার চেষ্টা করেছেন। তার সততার পুরস্কার বোধহয় তিনি এভাবেই পাচ্ছেন। এসব নানা কিছু ভাবছেন তিনি। অফিসে ফিরে আসেন। ফুরফুরে মেজাজে সবার সঙ্গে অফিস ছাড়ছেন। বাসায় ফিরে ভাবছেন, একটা নতুন টিভি কিনবেন, আরও যা পুরনো হয়ে গেছে বলে চলছেই না, নানা কিছু কিনবেন। কিন্তু তাকে তিন দিন পর জানানো হবে। তিন দিন তার কাটছেই না। কোনোভাবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসল। অপেক্ষায় আছেন সোহরাব সাহেব। সেই কাক্সিক্ষত ফোনের আশায়। কিন্তু ফোন আসে না। বার বার পকেট থেকে ফোনটি বের করে দেখেন। কী ব্যাপার! ফোন ঠিক আছে তো! নাকি আবার কোনো সমস্যা হলো। কোনো ফোনই তো আসছে না। তিনি এক কলিগকে বললেন তার নম্বরে ফোন দিতে। আশা করছিলেন, যেন ফোনটি না বেজে ওঠে। নাহ! রিং বেজে উঠল। ফোনের দিকে তাকিয়ে সোহরাব হোসেন বিড়বিড় করছেন। ফোনতো ঠিক আছে, তবে ওই ফোনটি আসছে না কেন? নিজে নিন্ডেন্ডেজকে প্রশ্ন করছেন সোহরাব হোসেন। জবাব পান না। অফিস সময় শেষ হয়ে যায়। ফোনটি পকেট থেকে হাতে রাখে। বাসায় ফিরছেন। মহা টেনশনে তিনি। সেইদিন পার হয়ে নতুন দিন আসে। সব কিছুই পরিকল্পনা মতো চলছে। শুধু ফোনটি আসছে না। চার দিন পেরিয়ে গেল। অফিসে বসে সেই অপেক্ষা। ফোন না আসলে চিঠি আসবে। বলেছিল ওরা। সেটিও আসেনি। অস্থির সোহরাব সাহেব। অফিস টাইম শেষ। অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন। সোহরাব সাহেব বাসায় ফিরেন। সেই নম্বরে ফোন দেন। ফোন যাচ্ছে না। রিডায়াল করতে থাকেন। না, ফোন বন্ধ। সব নম্বরই বন্ধ। সোহরাব সাহেবের বুকটা কেঁপে ওঠে। পাগলের মতো ফোন করতে থাকেন। কোনো লাভ হয় না। বুকের ভিতর চিন চিনে ব্যথা অনুভব করতে থাকেন। কেমন যেন শরীর গুলিয়ে ওঠে তার। পুরো দুনিয়া যেন দুলছে তার চোখের সামনে।

চোখ খোলার চেষ্টা করছেন সোহরাব হোসেন। অস্পষ্ট লাগছে সব। ভালো করে দেখার চেষ্টা করছেন। তাকে ঘিরে আছে স্ত্রী সন্তান আর চিকিৎসক। চারপাশে মাথা ঘুরিয়ে দেখেন, তিনি হাসপাতালে। তার স্ত্রী খোদেজা আঁচলে চোখ মোছেন। সবাই তাকিয়ে। জ্ঞান ফিরেছে বলেই আনন্দের কান্না তাদের। কী হয়েছিল তা মনে করার চেষ্টা করেন সোহরাব। বুঝতে পারেন অফিসেই বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলেন। সহকর্মীরা হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল। দ্রুত হাসপাতালে এসেছিলেন, এ যাত্রায় বেঁচে গেলেন। ডাক্তারের হাসিমুখ দেখলেন। সুস্থ হওয়ার পর সোহরাব হোসেন খুলে বলেন সব। এক যুবক ফোন করেই তাকে বলছেন, স্যার, আচ্ছালামু আলাইকুম। আমি গ্রামীণ ফোন থেকে বলছি। যারা দীর্ঘদিন গ্রামীণ ফোন ব্যবহার করছেন এবং যাদের বিরুদ্ধে কখনো কোনো অভিযোগ হয়নি, এমন দুই লাখ সেরা গ্রাহকের মধ্যে লটারি করা হয়েছে। সেরা দুই লাখ গ্রাহকের মধ্যে দ্বিতীয় ভাগ্যবান আপনি। আপনি পুরস্কার হিসেবে পাবেন একটি বারো সিটের নতুন মাইক্রোবাস কিংবা ২২ লাখ নগদ টাকা। পুরস্কারের চিঠি হাতে পাওয়ার আগে ফোনে জানিয়ে দেওয়া হবে। আর এ জন্য রেজিস্ট্র্রেশন করতে ৫ লাখ টাকা লাগবে। তবে বিষয়টি কাউকে বলা যাবে না। সে অনুযায়ী তাদের দেওয়া নম্বরে সোহরাব হোসেন ৫ লাখ টাকা পাঠিয়ে দেন। এরপর ফোন না আসায় বুঝতে পারেন, তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। জানা গেছে, এ রকম কোনো লটারি কিংবা পুরস্কার প্রদানের বিষয় পুরোপুরি ভিত্তিহীন। সোহরাব সাহেব প্রতারিত হয়েছেন। তার সারাজীবনের সঞ্চয় এভাবে প্রতারকচক্র হাতিয়ে নিল! এ জীবনে আর কাউকে তিনি এবং তার পরিবার বিশ্বাস করবে না। সোহরাব সাহেব চরম ধাক্কা খেয়ে শিখলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক, সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, প্রতারণা ও প্রতারকের ইতিহাস অনেক পুরনো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শুধু ধরন পাল্টায়। আমরা যদি একটু সতর্ক হই, চিন্তাভাবনায় যৌক্তিক হই, লোভ পরিহার করি তাহলে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কমে যাবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর