শুক্রবার, ৪ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

মিরসরাই থেকেই শিল্পবিপ্লবের সূচনা

মানিক মুনতাসির

মিরসরাই থেকেই শিল্পবিপ্লবের সূচনা

চট্টগ্রামের  মিরসরাইয়ে প্রায় তিন হাজার একর এলাকাজুড়ে গড়ে উঠছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। দেশের সবচেয়ে বড় এই ইকোনমিক জোনে প্রত্যক্ষভাবে সাত লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। এখান থেকেই শুরু হবে শিল্পনির্ভর বাংলাদেশের সূচনা। এ জোনে ভারতের আদানী, জাপানের সুজিত, বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী গ্রুপ বসুন্ধরা, পাওয়ারপ্যাক, বিএসআরএম, হ্যামকো, গ্রেটওয়াল ও জয়েন্টভেঞ্চার নিপ্পন-ম্যাকডোনাল্ডসহ মোট ৫৯টি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করছে। এতে বিনিয়োগ প্রস্তাব ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকার, যার প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকাই বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব। বাংলাদেশ  ইকোনমিক জোন অথরিটির (বেজা) একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, চলতি মাসেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে স্থাপিত প্রথম শিল্প হিসেবে উৎপাদনে যাচ্ছে একটি চাইনিজ কেমিক্যাল কোম্পানি। এরপর ডিসেম্বরের আগেই উৎপাদনে যাচ্ছে বসুন্ধরা গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। এটি হবে দেশের সবচেয়ে বড় ও সমন্বিত শিল্পনগর। উৎপাদন থেকে বাজারজাত করতে যত ধরনের সেবার প্রয়োজন সবকিছুই থাকবে এই একই ছাতার নিচে। এ জন্য এই জোনের সঙ্গেই থাকবে নিজস্ব সমুদ্রবন্দর। আকাশ, সড়ক ও নৌ-পথের পাশাপাশি থাকবে রেলযোগাযোগ। প্রাকৃতিক পরিবেশ অক্ষুণœ রাখতে ও শ্রান্তি বিনোদনের জন্য থাকবে একাধিক সরোবর। যা শেখ হাসিনা সরোবর নামে পরিচিতি পাচ্ছে। সম্প্রতি বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর দফতরে গিয়ে তার সামনে ইকোনমিক জোনগুলোর সর্বশেষ আপডেট নিয়ে একটি প্রেজেন্টেশন তুলে ধরেন। সেখানকার প্রায় ৯০ ভাগ আলোচনাই ছিল মিরসরাইকে ঘিরে। এ জোনে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ নিয়ে আসছে চীন, ভারত, জাপান, সৌদি আরব ও সিঙ্গাপুর। এসব শিল্পাঞ্চল ঘিরে আগামী ১৫ বছরের মধ্যে অন্তত ১ কোটি লোকের কর্মসংস্থান করতে চায় বেজা। এসব জোনে গড়ে ওঠা শিল্প বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে ২০৪১ সালের আগেই সারা দেশে শিল্পবিপ্লব ঘটবে বলে আশা করছে বেজা।

জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে রয়েছে বিশ্বব্যাংক, আইএফসি, জাইকা, বিশ্বব্যাংক গ্রুপ, এডিবি, ডিএফআইডিসহ দেশি-বিদেশি অনেক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান। এ শিল্পনগরে এখন পর্যন্ত (১৪ বিলিয়ন ডলার) ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪ বিলিয়ন ডলারই বিদেশি বিনিয়োগ। এ জোনে থাকবে নিজস্ব সমুদ্রবন্দর। এর জন্য ইতিমধ্যে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিও করেছে বেজা। খুব শিগগিরই এ অংশের ভূমি উন্নয়নের কাজ শুরু হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের প্রধান সড়ক সরাসরি যুক্ত হবে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় নির্মাণাধীন বে-টার্মিনালের সঙ্গে। পানি ও সড়ক পথের পাশাপাশি থাকবে রেল যোগাযোগও। শ্রান্তি বিনোদন ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে অক্ষুণœ রাখতে এ প্রকল্পের ভিতরে গড়ে তোলা হচ্ছে শেখ হাসিনা সরোবর। শুধু এ জোনেই অন্তত সাত লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে বলে মনে করে বেজা। বিশাল এ কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে আগামী ১৫ বছরে অন্তত এক কোটি লোকের কর্মসংস্থান হবে। রপ্তানি আয় দাঁড়াবে ৪০ বিলিয়ন ডলারে। এর ফলে দেশের অর্থনীতিতে আসবে এক অভাবনীয় পরিবর্তন। যা অন্তত ২ শতাংশ জিডিপি বাড়াবে বলে মনে করে বেজা।

জানা গেছে, দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী গ্রুপ বসুন্ধরা এ জোনে ৫০০ একর জায়গাজুড়ে গড়ে তুলছে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এ গ্রুপের একটি কোম্পানি চলতি বছরই উৎপাদনে যাবে বলে জানিয়েছে বেজা। এ ছাড়া এখানে বিনিয়োগ করছে ভারতের বিখ্যাত আদানী গ্রুপ। জাপানের বিনিয়োগের জন্যও রাখা হয়েছে এক হাজার একর জায়গা। এ ছাড়া এ জোনে দেশীয় কোম্পানি পাওয়ারপ্যাক, এসিআই, বার্জার, হ্যামকো, গ্রেটওয়াল, বিজিএমইএসহ মোট বিনিয়োগকারী দেশ ও প্রতিষ্ঠান ৫৯টি। তিন হাজার একর জায়গা রাখা হয়েছে ভারত, সৌদি আরব, জাপানের জন্য। এসব জায়গায় ইতিমধ্যে শিল্প কারখানা নির্মাণের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। চলতি বছরের শেষে এবং আগামী বছরের শুরুতে এ জোনের বিনিয়োগ কর্মযজ্ঞ আরও বেশি দৃশ্যমান হবে বলে মনে করেন বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী। বিশ্বব্যাংক এ অঞ্চলকে একটি ফিন্যান্সিয়াল ডিস্ট্রিক্ট হিসেবে গড়ে তুলতে চায় বলে জানান তিনি। 

পবন চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরে বেশি দৃশ্যমান হবে এ কর্মযজ্ঞ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে ৮০ হাজার বর্গফুটের পাঁচতলা প্রশাসনিক ভবনের তিনতলা পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে এটির নির্মাণ সম্পন্ন হবে। কমপক্ষে ১০টি ব্যাংক এই ভবনে শাখা খুলতে পারবে। এখন পর্যন্ত অন্তত ৩০টি ব্যাংক এ অঞ্চলে তাদের শাখা খোলার জন্য আমাদের জানিয়েছে। টিকে গ্রুপের একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ১২০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প দ্রুতই উৎপাদনে যাবে। বাংলাদেশ-চায়না জয়েন্টভেঞ্চার একটি কোম্পানি গাড়ি প্রস্তুত কারখানা গড়ে তুলছে। জাপান-বাংলাদেশ জয়েন্টভেঞ্চার আরেকটি কোম্পানির কারখানা নির্মাণ কাজ শুরু করেছে। নিপ্পন-ম্যাকডোনাল্ড নামের এ কোম্পানিটি খুব দ্রুতই উৎপাদনে যাবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীর সঙ্গে কী ধরনের শর্ত যুক্ত হচ্ছে তা প্রকাশের দাবি জানিয়েছে টিআইবি-এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পবন চৌধুরী বলেন, আমরা তো শতভাগ উন্মুক্ত। তবে তাদের এই পর্যবেক্ষণকে আমরা ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি। জাপানের একটি কোম্পানি যেটি থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্ডিয়াতে আছে। সেই কোম্পানিকে আমরা নিয়ে এসেছি। এটা তো আমাদের বিরাট অর্জন। আমরা কিন্তু কোনো কোম্পানিকে জমি লিখে দিচ্ছি না। বিদেশি কোম্পানিগুলোকে আমরা শুধু জমি ভাড়া দিচ্ছি। সেখানে সরকারের সঙ্গে তারা ইক্যুইটি পার্টনার হিসেবে কাজ করছে। এখান থেকে সরকার প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ রাজস্বও পাবে। জানা গেছে, চলতি বছর এখানে আরও দুই হাজার একর জমি উন্নয়নের কাজ হবে। বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (বেপজা) ১১০০ একর জমির উন্নয়ন করছে। এসব জোনের কাজ দ্রুত শেষ করতে ও শিল্প বিনিয়োগ বাড়াতে বেজা ১১ ধরনের সেবা দিচ্ছে অনলাইনে। এর মধ্যে প্রকল্প অনুমোদন, প্রকল্প নিবন্ধন, ভিসা সহায়তা, ভিসা সুপারিশ, আমদানি ও রপ্তানি অনুমোদন, ওয়ার্ক পারমিট, লোকাল ক্রয় ও বিক্রয় পারমিট ও স্যাম্পল এক্সপোর্ট পারমিট। এ ছাড়া স্টেকহোল্ডারদের জন্য ২০১৮ সাল থেকেই ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করেছে বেজা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর