শনিবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

নতুন পণ্য নিয়ে নতুন বাজারে বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্রে আগের তুলনায় রপ্তানি আয় বেড়েছে ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

নতুন পণ্য নিয়ে নতুন বাজারে বাংলাদেশ

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে, তার তথ্য অনুযায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম (জুলাই) মাসে অন্তত ৩৪ ধরনের পণ্য রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। এগুলো হলো নিট পোশাক, ওভেন পোশাক, নিট ফ্যাব্রিকস, স্পেশাল টেক্সটাইল, ফলমূল, বাইসাইকেল, ক্র্যাবস, তামাক, ক্যামিকেল প্রোডাক্টস, ওষুধ, ফার্নিচার, চামড়াজাত পণ্য, চামড়ার জুতা, কপার ওয়্যার, কার্পেট, শাকসবজি, টেরি টাওয়েলস, প্রকৌশল যন্ত্রাংশ, কাগজ পণ্য, প্লাস্টিক দ্রব্যাদি, ক্যাপ, হ্যান্ডিক্রাফটস, অন্যান্য ম্যানুফ্যাকচারিং দ্রব্য, চা, গলফ সাফট, জুতা (চামড়া ব্যতীত), রাবার, পাট ও পাটজাত পণ্য, জুট ইয়ার্ন অ্যান্ড টোয়াইন, হোম টেক্সটাইল, প্রকৌশল দ্রব্যাদি, জাহাজ, ইলেকট্রিক পণ্য, হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ। এর মধ্যে জুলাই মাসে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ রপ্তানিতে প্রায় ১০৮ শতাংশ।  এরপর বাইসাইকেল রপ্তানিতে ৭৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ, প্লাস্টিক-মেলামাইন পণ্যে ৩৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ, ওষুধ বা ফার্মাসিউটিক্যালস খাতে ২৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ এবং চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকায়  প্রায় ১৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। রপ্তানি আয়ে বাংলাদেশের প্রধান দুটি খাত নিট পোশাকে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং ওভেন পোশাকে ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে জুলাই মাসে। ইপিবির কর্মকর্তারা বলছেন, এখানে এমন অনেক পণ্য রয়েছে, যেগুলো এক দশক আগেও রপ্তানি তালিকায় ছিল না। এখন এসব পণ্যের রপ্তানি বছরে প্রায় মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাচ্ছে। শুধু পণ্যভিত্তিক নয়, দেশভিত্তিক পণ্য রপ্তানিতেও ভালো করছে বাংলাদেশ।

প্রচলিত বাজারের পাশাপাশি নতুন নতুন দেশে বাংলাদেশের পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপরন্তু দেশের সবচেয়ে বড় বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগের তুলনায় চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে রপ্তানি আয় ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ বেড়েছে। দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার জার্মানিতে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৫৬৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বেশি আয় হয়েছে।

নতুন বাজারে রপ্তানি বাড়ছে দ্রুত হারে : ইপিবির তথ্যমতে, গত অর্থবছরে অপ্রচলিত ও নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার, যা এর আগের অর্থবছরে ছিল ৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের। প্রায় ২২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে পোশাক রপ্তানিতে। বর্তমানে নতুন বাজারে রপ্তানির ক্ষেত্রে ৪ শতাংশ নগদ সহায়তা দেওয়া হয়। নতুন বাজারের তালিকায় রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান, ভারত, চিলি, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্ক, সুইজারল্যান্ড, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডসহ আরও কয়েকটি দেশ। এসব দেশে তৈরি পোশাক ছাড়াও হোম টেক্সটাইল, টেরি টাওয়েল, কটন ও কটন পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্য, হিমায়িত মাছ, ক্র্যাসটাসিন্স, শাকসবজি, শুকনো খাবার, গুঁড়া মসলা, রাবার, তামাক, প্লাস্টিক ও মেলামাইন, হ্যান্ডিক্রাফটসহ অন্তত ৩০ ধরনের পণ্য রপ্তানি হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, রপ্তানি খাতকে উৎসাহিত করতে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যের ওপর অনেক আগে থেকে নগদ সহায়তা দিয়ে আসছে সরকার। নতুন পণ্য রপ্তানিতে ৩৬টি খাতে সর্বনিম্ন ২ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত প্রণোদনা সুবিধা রয়েছে। নতুন করে আরও ৯টি পণ্যে নগদ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়া নতুন পণ্য এবং বাজার সম্প্রসারণে ৪ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এসব কারণে নতুন বাজারে নতুন পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে।

রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে দ্বিতীয় বাংলাদেশ : গত আগস্টে প্রকাশিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিস্টিক্যাল রিভিউ-২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ববাণিজ্যে বাংলাদেশ এখন ৪২তম বড় রপ্তানিকারক দেশ। বিশ্বে যে কটি দেশের রপ্তানি আয় খুব দ্রুত বাড়ছে, এর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। রপ্তানি আয় বৃদ্ধির দিক দিয়ে অগ্রসরমাণ অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ভিয়েতনাম। এর পরই বাংলাদেশের অবস্থান। গড় হিসাবে এক দশক ধরে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে দুই অঙ্কের কাছাকাছি। সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের এই অগ্রযাত্রায় প্রধান ভূমিকা রেখেছে পোশাক খাত। পোশাক রপ্তানিতে একক দেশ হিসেবে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। শীর্ষে চীন। তবে অল্প অল্প করে অন্যান্য অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানিতেও সফল হচ্ছে বাংলাদেশ। শুধু তা-ই নয়, ইউরোপ, আমেরিকার বড় বড় বাজারের পাশাপাশি এখন নতুন নতুন অনেক বাজার তৈরি হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বাড়ছে আশানুরূপ হারে।

সুযোগ আছে আরও : বাংলাদেশের যে রপ্তানি আয়, সেটি আরও অনেক বেশি বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।  বিশ্বকাপ ফুটবলে লাতিন আমেরিকার প্রতিনিধিত্বকারী চারটি দেশ ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে ও প্যারাগুয়ের একটি জোট রয়েছে, যার নাম ‘মারকোসার’। এটি মূলত দক্ষিণ আমেরিকার ওই দেশগুলোর একটি বাণিজ্য জোট, যা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালে। এ জোটের বার্ষিক জিডিপি ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। এখানে ক্রেতা বা ভোক্তার সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি। আর এই ৩০ কোটি ক্রেতার বাজার ধরতে এবার মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ওই চারটি দেশকে যদি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে সম্মত করানো যায়, তবে সেখানে বাংলাদেশি পণ্য শূন্য শুল্কে রপ্তানির সুবিধা পাওয়া যাবে। শুল্কহার হ্রাস বা শূন্য করা সম্ভব হলে ওই অঞ্চলে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে। আর এ লক্ষ্যে মারকোসার জোটভুক্ত দেশগুলোতে সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সফর করে এসেছে। ওই সফরে বাংলাদেশকে শুল্ক সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা। এ ছাড়া রুশ ফেডারেশনের নেতৃত্বাধীন ইকোনমিক কমিশনের সঙ্গেও দ্বিপক্ষীয় চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে। এই চুক্তি হলে রাশিয়া ছাড়াও কমিশনের সদস্যরাষ্ট্র বেলারুশ, কাজাখস্তান, আর্মেনিয়া ও কিরগিজিস্তানে শূন্য শুল্কে পণ্য রপ্তানির সুবিধা পাবে বাংলাদেশ।

রপ্তানি খাতে বাংলাদেশের এই অদম্য অগ্রযাত্রা সম্পর্কে বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দীন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের রপ্তানি আয় বাড়াতে নতুন নতুন বাজার অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তৈরি পোশাকের পাশাপাশি সম্ভাবনাময় অন্যান্য পণ্যের রপ্তানি আয় বাড়ানোর জন্য বাণিজ্য সহজীকরণ ছাড়াও রপ্তানিকারকদের বিভিন্নভাবে প্রণোদনা ও সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। যেসব দেশে শুল্ক বেশি সেসব দেশে রপ্তানি বাড়াতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে রপ্তানি আয় ৬০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে এখন লক্ষ্যমাত্রা সাজানো হচ্ছে।’

সর্বশেষ খবর