শনিবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

তবুও বিশৃঙ্খল রাজপথ

মাসে দুই লাখ মামলা, পুলিশের সামনে চলে নৈরাজ্য

শামীম আহমেদ

রাজধানীতে নিবন্ধিত যানবাহন প্রায় ১৫ লাখ। এর অর্ধেকের কাছাকাছি প্রায় ৭ লাখ মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন। ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনে প্রতিদিন ঢাকায় গড়ে মামলা হচ্ছে সাড়ে ৬ হাজার। মাসে মামলার সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজারের বেশি। তবু রাজধানীর সড়কে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা দূর হচ্ছে না। যানবাহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে রাজধানীর বিভিন্ন ফাঁকা সড়কে ট্রাফিক পুলিশকে চেকপোস্ট বসাতে দেখা গেলেও স্টপেজগুলোয় পুলিশের সামনেই নৈরাজ্যে মেতে উঠছে বাসগুলো। খুশিমতো লেন পরিবর্তন, মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলা, বাসে বাসে ঠোকাঠুকি, আঁকাবাঁকা গাড়ি রেখে সড়ক বন্ধ করে দেওয়াসহ নিয়ম ভাঙায় যেন প্রতিযোগিতা চলছে। গত কয়েক বছরে রাজধানীতে যতগুলো বাস দুর্ঘটনায় প্রাণ ও অঙ্গহানির ঘটনা ঘটেছে তার অধিকাংশই ঘটেছে বাস স্টপেজে।

গত মাসের শেষ ১০ দিনে (২৬ সেপ্টেম্বর বাদে) যানবাহন ও চালকদের বিরুদ্ধে ৬৫ হাজার ৬১৮টি মামলা করে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ। জরিমানা করা হয় ২ কোটি ৮৩ লাখ ৬ হাজার টাকা। ৩৬০টি যানবাহন ডাম্পিং ও ৮ হাজার ৩৮০টি রেকার করা হয়। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৯ হাজার ৯২৬টি মামলা হয় মোটরসাইকেলের বিরুদ্ধে। আটক করা হয় আরও দেড় হাজার মোটরসাইকেল। হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারে ১ হাজার ৮৪৩টি, হুটার ও বিকনলাইট ব্যবহারে ৪৫টি, উল্টোপথে গাড়ি চালানোয় ৮ হাজার ৬৯৫টি, মাইক্রোবাসে কালো গ্লাস ব্যবহারে ১১৫টি, গাড়ি চালানোর সময় মোবাইলে কথা বলায় ৫৯৮টি মামলা হয়। বাকি মামলার অধিকাংশ হয় গাড়ি চালানোর সময় ধূমপান, সিটবেল্ট না বাঁধা, গাড়িতে স্টিকার ব্যবহার, ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির কাগজপত্র ও ইন্স্যুরেন্সের মেয়াদ না থাকার মতো ঘটনায়। বিপুলসংখ্যক মামলা ও জরিমানার পরও বন্ধ হচ্ছে না সড়কে নৈরাজ্য। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়কে বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী চাঁদা দিয়ে চলা কয়েক লাখ অবৈধ যানবাহন। পুলিশ এগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। সরেজমিন রাজধানীর ৩০০ ফুট সড়ক, হাতিরঝিলসহ বিভিন্ন ফাঁকা সড়কে চেকপোস্ট বসিয়ে পুলিশকে যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলা দিতে দেখা গেলেও স্টপেজগুলোয় বাসের নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। গত বুধবার দুপুরে শাহজাদপুরের কনফিডেন্স শপিং মলের সামনের সড়কটি যাত্রী তুলতে গিয়ে পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় কয়েকটি বাস। পেছনে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজট। অথচ ওই বাসগুলোর ১০ গজ দূরেই তখন নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে ছিল পুলিশের একটি টহল গাড়ি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীতে পুলিশকে মাসিক চাঁদা দিয়ে চলছে অসংখ্য ফিটনেস ও নিবন্ধনবিহীন যানবাহন। কাগজপত্রবিহীন এ গাড়িগুলো কাউকে পরোয়া করে না। পুলিশ, স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা এবং পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠন- মূলত এই তিন খাতে চাঁদা দিয়ে চলছে এগুলো। এসব যানবাহনের মধ্যে বাস, মিনিবাস যেমন আছে, তেমন আছে লেগুনা, ইজিবাইক ও সিএনজিচালিত প্রাইভেট অটোরিকশা। চাঁদা দিয়ে চলায় পুলিশকেও এরা পরোয়া করে না। ওপরের নির্দেশে মাঝেমধ্যে কিছু গাড়ি রেকার ও ডাম্পিং করা হলেও অধিকাংশই চলছে বহালতবিয়তে। সূত্র জানায়, সংশ্লিষ্ট এলাকার সার্জেন্টের মাধ্যমে এসব গাড়ির লেনদেনের বিষয়গুলো দফারফা হয়। এক এলাকার সার্জেন্টের সঙ্গে চুক্তি করা অবৈধ গাড়ি অন্য এলাকায় গিয়ে ধরা পড়লে মোবাইলে সংশ্লিষ্ট সার্জেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হয়। এতেই সমস্যা সমাধান হয়ে যায়। কেউ কেউ আবার বিশেষ টোকেনের ব্যবস্থা করেছে, যা দেখালেই পুলিশি ঝামেলা থেকে মুক্তি মেলে। যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাবে ঢাকাতেই ৫ লাখের বেশি অবৈধ যানবাহন চলছে। এর মধ্যে বাস, মিনিবাস ছাড়াও আছে ছোট ও হালকা যান। সংস্থাটির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘বঙ্গভবনের সামনে দিয়ে যে লেগুনাগুলো বাসাবো যায় সেগুলো তো মূল সড়কে চলার কথা নয়। পুলিশকে টাকা দিয়ে চলছে। প্রতিদিন পুলিশ ৭-৮ হাজার মামলা দিচ্ছে যার ৮৫ ভাগই মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারের বিরুদ্ধে। বিপুল পরিমাণ জরিমানা আদায় করে কৃতিত্ব দাবি করছে। পুলিশ তো রাজস্ব আহরণকারী প্রতিষ্ঠান নয়। তাদের দায়িত্ব সড়কে শৃঙ্খলা বজায় রাখা। সেখানেই তারা ব্যর্থ। পুলিশের সঙ্গে চুক্তি করে চলা অবৈধ যানবাহনগুলোই সবচেয়ে বেপরোয়া। ঢাকায় একটি বাস থেকে দিনে গড়ে প্রায় ২ হাজার টাকা, লেগুনা ও সিএনজি অটোরিকশা থেকে ৭০০ টাকা চাঁদা ওঠে। সড়কে বিশৃঙ্খলা ও অধিকাংশ দুর্ঘটনার জন্য এগুলো দায়ী। প্রায় সবকটি দুর্ঘটনার পর দেখা গেছে গাড়িটির সড়কে চলার বৈধতা নেই। এসব অবৈধ যানবাহন কোনো অপরাধ ঘটালেও তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন।’ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ জানান, ‘সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে তারা অভিযান অব্যাহত রেখেছেন। যানবাহনকে আইনের মধ্যে রাখতেই এ মামলা ও জরিমানা। কাউকে ছাড়ের সুযোগ নেই। ফিটনেসবিহীন ও কাগজপত্র ছাড়া গাড়ি ডাম্পিং ও রেকার করা হচ্ছে। পুলিশের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তদন্তসাপেক্ষে আইননানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর