মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

যেসব কারণে পাহাড়ে চলছে রক্তের হোলি

সময়ের সঙ্গে দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি, দুই দশকে ১১০০ খুন

মুহাম্মদ সেলিম, খাগড়াছড়ি থেকে ফিরে

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় চার আঞ্চলিক সংগঠন দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বসহ নানা কারণে এ চার সংগঠনের প্রশিক্ষিত ক্যাডাররা খুনোখুনির উৎসবে মেতে উঠছে। প্রতিনিয়তই ঘটছে খুনের ঘটনা। শুধু নিজেদের মধ্যে খুনোখুনিতে থেমে থাকছে না তারা। তাদের প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছে সাধারণ বাঙালিরাও। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে। গত দুই দশকে তিন পার্বত্য জেলায় খুন হয়েছেন কমপক্ষে ১১০০ জন। পার্বত্য অঞ্চলের আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর আগ্রাসী মনোভাবকে অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন বিশেযজ্ঞরা। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, পার্বত্য অঞ্চলের সংগঠনগুলো আদর্শচ্যুত হয়ে চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েছে। চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ ও এলাকায় আধিপত্য ধরে রাখতে পরস্পরের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। পাহাড়ের সংঘাতের মূল কারণই হচ্ছে চাঁদাবাজি। যত দিন চাঁদাবাজি বন্ধ হবে না তত দিন দীর্ঘ হতে থাকবে লাশের সারি। তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে চিরুনি অভিযান শুরু করতে হবে। একই সঙ্গে যেসব সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে সেগুলো পুনঃস্থাপন করতে হবে।

চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইডি খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

বিভিন্ন সংস্থার দেওয়া তথ্য মতে, গত দুই দশকে তিন পার্বত্য জেলায় খুন হয়েছেন কমপক্ষে ১১০০ জন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১৪০০। অপহরণ হয়েছেন প্রায় চার হাজার। যার মধ্যে গত এক বছরে খুন হয়েছে অর্ধশতাধিকেরও বেশি মানুষ।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামে চাঁদা দেওয়া ছাড়া কেউ বসবাস করতে পারে না। ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ লোকজন সবাইকে চাঁদা দিয়েই এখানে বসবাস করতে হয়। পরিবহন সেক্টর, ঠিকাদার, মুদি দোকানদার, সরকারি চাকরিজীবী, এনজিও সংস্থাসহ সবাইকে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোকে চাঁদা দিতে হয়। ছয় মাস এবং বার্ষিক হারে এ সংগঠনগুলোকে চাঁদা দিয়ে নিতে হয় কথিত ‘কার্ড’। কেউ চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তার ওপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন। এমনকি খুনের ঘটনাও ঘটেছে অহরহ। শুধু চাঁদাবাজি নয়, আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর মধ্যে আধিপত্য বিস্তার, খুনের বদলা হিসেবে খুন এবং সাংগঠনিক দ্বন্দ্বের কারণে তিন পার্বত্য এলাকায় দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি। দুই দশক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে চুক্তি হয়। যা পরে শান্তি চুক্তি হিসেবে পরিচিতি পায়। কিন্তু এ চুক্তির বিরোধিতা করে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) আত্মপ্রকাশ ঘটে। ২০১০ সালে জেএসএস আরেক দফা ভাঙনের মুখে পড়ে। আত্মপ্রকাশ ঘটে জেএসএস-এমএন-এর। সর্বশেষ ইউপিডিএফ ভেঙে  হয় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। বর্তমানে এ চারটি সংগঠনই তিন পার্বত্য অঞ্চলে কাজ করছে। ২০০১ সালে রাঙামাটির নানিয়ারচরে তিন বিদেশিকে অপহরণের মাধ্যমে ফের পাহাড়ে অপরাজনীতি শুরু হয়। এরপর খুন, গুম, অপহরণ, চাঁদাবাজি এবং আধিপাত্য বিস্তার নিয়ে সংঘাত এ অঞ্চলের নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। সংঘাতে প্রাণ হারায় শত শত মানুষ। আধিপাত্য বিস্তার নিয়ে শুধু নিজেরাই সংঘাতে জড়ায়নি পার্বত্য অঞ্চলের এ সংগঠনগুলো। চাঁদা না দিলে প্রায় সময়ই হামলার শিকার ও নির্যাতন সইতে হয় সাধারণ বাঙালিদের। এমনকি খুনের ঘটনাও ঘটছে অহরহ। অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও তাদের হামলার শিকারে পরিণত হন।

সর্বশেষ খবর