বুধবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ফুটপাথে দখল বাণিজ্য দুই সিটিতে

উত্তরের সর্বত্র, দক্ষিণের দেড় শ পয়েন্টে বেহাল পরিস্থিতি অবৈধ হাটবাজার, গজিয়ে উঠেছে ১৭ টার্মিনাল

সাঈদুর রহমান রিমন

ফুটপাথে দখল বাণিজ্য দুই সিটিতে

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সর্বত্র এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অন্তত দেড়শ পয়েন্টে ফুটপাথ-রাস্তা জবরদখলসহ অসংখ্য পয়েন্টে গড়ে উঠেছে অবৈধ হাটবাজার। রাস্তা-গলি মোড় দখল করে ব্যস্ততম রাজধানীতে অবৈধভাবেই গড়ে উঠেছে অন্তত ১৭টি বাস-ট্রাক টার্মিনাল। এসব ঘিরে চলছে চাঁদাবাজির মহোৎসব। দখলবাজরা প্রতি বছর লুটে নিচ্ছে শত শত কোটি টাকা। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী, পুলিশ আর সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সিন্ডিকেট এসব বখরা ভাগ করে নিচ্ছে। প্রশাসনের নানা উদ্যোগেও ফুটপাথ-রাস্তা জবরদখলমুক্ত হয় না, দূর হয় না নগরবাসীর ভোগান্তি।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা মতিঝিল, দিলকুশা, দৈনিক বাংলা, বায়তুল মোকাররম, জিপিও, পুরানা পল্টন, গুলিস্তান, শাহবাগ, ফার্মগেট, সদরঘাট, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন স্থানে ফুটপাথ দখল করে প্রতিদিনই বসছে পণ্যের পসরা। এসব স্থানে লোক চলাচল দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোথাও কোথাও ফুটপাথ ছাড়িয়ে মূল সড়কেরও অর্ধেকটা জুড়ে বসছে পণ্যের পসরা। ফলে নগরীতে পথচারীদের ভোগান্তি আর সড়কের যানজট তীব্র আকার ধারণ করছে। অবৈধ দখল ও চাঁদাবাজির শীর্ষস্থান হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে গুলিস্তান এলাকা। সেখানে মোট ১৫টি জোনে ভাগ করে চাঁদাবাজি নিশ্চিত করা হয়। জোনগুলোর চাঁদা আদায়ের দায়িত্বে আছে একটি রাজনৈতিক সংগঠনের কয়েকজন শ্রমিক নেতা। ফার্মগেট এলাকা ভাগ করা হয়েছে তিনটি জোনে। একইভাবে নিউমার্কেট-সাইন্স ল্যাবরেটরির মোড় পর্যন্ত পাঁচটি জোন, পল্টন-বায়তুল মোকাররম এলাকায় চারটি জোন, মৌচাক-মালিবাগ, যাত্রাবাড়ী, জুড়াইন, সদরঘাট এলাকায় দুটি করে জোন রয়েছে। এ ছাড়াও গাবতলী বাস টার্মিনাল, ফুলবাড়িয়া টার্মিনাল চত্বর ও কারওয়ানবাজারের আশপাশ এলাকা এখন ফুটপাথ দখলবাজির বাজারে রমরমা হয়ে আছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের কাছে ওয়ার্ড কাউন্সিলররা ফুটপাথ-রাস্তার দখলবাজি উচ্ছেদের অঙ্গীকার করেছিলেন। তারা দখলবাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি কেউ, উপরন্তু কাউন্সিলরদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই ফুটপাথ দখলবাজিসহ বেপরোয়া চাঁদা বাণিজ্য চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সবচেয়ে বেহাল অবস্থা মতিঝিলের। গত তিন বছরে মতিঝিলের রাস্তায় সর্বোচ্চ সংখ্যক দুর্ঘটনা ঘটেছে। সেখানে গাড়ি চাপায় মারা গেছে অন্তত ৪০ ব্যক্তি, আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। এখানকার কোনো ফুটপাথ পথচারীদের জন্য উন্মুক্ত নেই। ব্যাংকপাড়া খ্যাত মতিঝিলে লাখো মানুষ প্রতিদিন যানবাহন চলাচলের ব্যস্ত সড়কেই ঝুঁকি নিয়ে হেঁটে চলাচল করে। সেখানে অলিগলি, রাস্তার ফাঁকফোকরে একচিলতে জায়গাও ফাঁকা রাখা হয়নি, গড়ে তোলা হয়েছে মার্কেট-বাজার। মতিঝিলের ফুটপাথে মাছ, মাংস, শাক-শবজি, ফল-মূল, আদা, পিয়াজ-রসুনসহ সব ধরনের মসলা, রান্নার সামগ্রী, দই-মিষ্টি, প্রসাধনী সামগ্রী, শার্ট-প্যান্ট, জুতা-বেল্টসহ ভোগ্যপণ্য থেকে বিলাস পণ্যের সবকিছুই মিলছে। মতিঝিল অফিস-পাড়ার ফুটপাথে মাছ-মাংস এবং মসলা ব্যবসায়ীরা দৈনিক ৫০০ টাকা করে চাঁদা দিচ্ছে। শার্ট-প্যান্ট, গেঞ্জি বিক্রেতারা চাঁদা দিচ্ছে ৩০০ টাকা করে। ভ্যানে করে মৌসুমি ফল বিক্রেতারা দিচ্ছে ২০০ টাকা। সবজি বিক্রেতারা দিচ্ছে ১৫০ টাকা হারে। ভ্রাম্যমাণ চা-সিগারেট বিক্রেতাদের থেকেও ১০০ টাকা করে চাঁদা আদায় হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। চাঁদা উত্তোলনকারীদের হাত থেকে বাদ যাচ্ছে না শরবত কিংবা চানাচুর বিক্রেতারাও। বঙ্গভবনের আশপাশ দিলকুশার ফুটপাথসহ অবৈধ ডলার বাজার, পূবালী ব্যাংক ভবন থেকে সোনালী ব্যাংক ভবন পর্যন্ত এলাকা, বিমান অফিস থেকে টয়োটা বিল্ডিং পর্যন্ত ফুটপাথ, মতিঝিল থানা থেকে মোহামেডান ক্লাব পর্যন্ত ফুটপাথ, তিতাস গ্যাস ভবন থেকে পূর্বাণী হোটেলের পূর্বপাশ পর্যন্ত সর্বত্রই চাঁদা তোলা হচ্ছে। প্রতিদিন মোটা অংকের টাকা আদায়ের কারণেই মতিঝিলের ফুটপাথগুলো মুক্ত করা যায় না। মতিঝিলের মতোই অভিন্ন অবস্থা গুলিস্তান, নিউমার্কেট, ফার্মগেট ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে। ফার্মগেটের খুদে হকাররা জানান, প্রতিদিন ‘পুলিশের বিট’ বাবদ ৫০ টাকা, হকারদের কল্যাণকারী নানা সংগঠনের চাঁদা ৩০ টাকা এবং স্থানীয় ক্লাব-সমিতির নামে আরও ২০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। দোকানিদের কাছ থেকে চাঁদা তোলার জন্য প্রতি লাইনেই একজন করে দোকানদার ‘লাইনম্যান’ হিসেবে কাজ করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা রাজনৈতিক দলের পরিচয় বহন করে। গাউছিয়া মার্কেট থেকে এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগন্যাল মোড় পর্যন্ত সড়কটি অনেক আগেই হাটবাজারের জঞ্জালে পরিণত হয়ে আছে। সেখানে ফুটপাথ দখল করে দোকানপাট গড়ে তোলা হয়েছে, বাজার বসেছে রাস্তার অর্ধেকটা দখল করেই।

বিমানবন্দর স্টেশন সংলগ্ন এলাকার ব্যস্ততম ফুটপাথ ও সড়ক কোনোভাবেই দখলমুক্ত করা গেল না। রেলস্টেশন সংলগ্ন মনোলোভা কাবাব ঘর থেকে এপিবিএন ব্যাটালিয়ন কার্যালয় পর্যন্ত ফুটপাথে মোবাইল কোর্টের অভিযান, সিটি করপোরেশনের উচ্ছেদ তৎপরতা এবং রেল ও সড়ক বিভাগ থেকে মামলা দায়েরের হুমকি-ধমকির কোনো কিছু দখলবাজদের কাছে পাত্তা পাচ্ছে না। সম্প্রতি র‌্যাব-পুলিশের সমন্বয়ে মোবাইল কোর্টের সহায়তায় উত্তর সিটি করপোরেশন ব্যাপক অভিযান চালিয়ে বিমানবন্দর এলাকার কয়েকশ দোকানপাট উচ্ছেদ করে দেয়। ৫/৬ দিনের মধ্যেই প্রভাবশালী চক্রটি রাস্তার সে জায়গা পুনরায় দখল করে নেয়। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘেঁষা ফুটপাথ বাজারগুলো ঘিরে চলে মলম পার্টির তৎপরতা। সেখানে ১০/১২ জন সন্ত্রাসীর একটি সিন্ডিকেট ফুটপাথের দোকানি থেকে শুরু করে ভ্রাম্যমাণ বাদাম বিক্রেতা এমনকি ভিক্ষুকদের থেকেও চাঁদার নামে টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়। মূলত বিমানবন্দর রেলস্টেশনকে ঘিরে গড়ে ওঠা ফুটপাথ বাজারটি এখন প্রধান সড়কজুড়ে হাজী ক্যাম্প পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। সাড়ে তিন শতাধিক দোকান আছে সেখানে, প্রতি দোকান থেকেই তোলা হয় ৪০০ টাকা করে চাঁদা। গোটা রাজধানীই অবৈধ দখলবাজির হাটবাজারে পরিণত হয়েছে। ফুটপাথ ও সংলগ্ন রাস্তা-গলির কোথাও জায়গা ফাঁকা রাখা যাচ্ছে না। যারা যেভাবে পারছে, সেভাবেই দখল করে জমিয়ে তুলছে বাজার, হাতিয়ে নিচ্ছে চাঁদা। গুরুত্বপূর্ণ মোড় ও পয়েন্টে কোনটা রাস্তা, কোনটা বাজার খুঁজে পাওয়াও কঠিন। গুলিস্তান, দিলকুশা, ফার্মগেট, উত্তরা, বিমানবন্দর ও মিরপুর ১ ও ১০ নম্বর গোলচক্কর এলাকায় রাস্তার আইল্যান্ডে পর্যন্ত বাজার বসানো হয়েছে।

বায়তুল মোকাররম সংলগ্ন ওভারব্রিজ ঘেঁষা জায়গায় রাস্তা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে ফলের বাজার। ফার্মগেট টেম্পোস্ট্যান্ডের আশপাশে পজিশন নিয়ে বসা হকারদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা হচ্ছে একটি রাজনৈতিক দলের যুব সংগঠনের ব্যানারে। কারওয়ানবাজারের মূল রাস্তাটি অলিখিত ইজারা দিয়ে চাঁদা তুলছে শ্রমিক ও যুব সংগঠনের কয়েক নেতা। ফার্মগেটের হকাররা জানান, প্রতিদিনের চাঁদার যন্ত্রণায় তারা অস্থির হয়ে পড়েছেন। মধ্যবাড্ডায় লুৎফুন টাওয়ার, হাকিম প্লাজার বিপরীত পাশেই আছে হাজী সুপার মার্কেট, হাজী নূরনবী সুপার মার্কেট, খান সুপার মার্কেট। এসব মার্কেট-সংলগ্ন ফুটপাথজুড়ে আছে নানা ভাসমান দোকান। রাজধানীর উত্তরা এলাকায় ফুটপাথ জবরদখল করে অবৈধ কাঁচাবাজার, দোকানপাট ও মাদক ব্যবসা বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে। উত্তরার বিভিন্ন সেক্টরের খোলা জায়গা, প্লট ও ফুটপাথ থেকে প্রতিদিন চাঁদা তুলছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর