শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

সামিউল-তুহিনদের প্রাণ যাচ্ছে বিকারগ্রস্ত বাবা-মার হাতে

৯ মাসে ২৮ শিশু হত্যা

জিন্নাতুন নূর

এক দশক আগে রাজধানীর আদাবরের আয়েশা হুমায়রা এশা নামে এক নারীর পরকীয়া সম্পর্কের কারণে প্রাণ দিতে হয় এশার ছয় বছর বয়সী শিশু সামিউল আজিমকে। দেশজুড়ে ঘটনাটির নিন্দা-সমালোচনা হয়। মায়ের প্ররোচনায় সন্তানের নৃশংস হত্যা ছিল চিন্তার বাইরে। কদিন আগে প্রায় একই নিষ্ঠুরতায় সুনামগঞ্জের শিশু তুহিনের হত্যাকাণ্ডে  হতবাক গোটা দেশবাসী। সমাজবিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন ১০ বছর আগে সামিউল হত্যার যে বীভৎসতা ছিল তার মাত্রা আরও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, দারিদ্র্য, মা-বাবার মানসিক ভারসাম্যহীনতা, পরকীয়া সম্পর্ক, সম্পদের প্রতি লোভ, মাদকাসক্তিসহ বেশকিছু কারণে মা-বাবা তার নিজের সন্তানকে হত্যা করছেন। বিষয়টির ভয়াবহতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের দেওয়া তথ্যে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ সংস্থাটির নয় মাসের প্রতিবেদন বলছে, মা-বাবার নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে ২৮টি শিশুর মৃত্যু হয়। এ ছাড়া এই সময়ে মা-বাবার নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছে আরও ১০টি। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সামাজিক মূল্যবোধের প্রবল অবক্ষয়ের কারণে শিশুদের ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। আর এমন হচ্ছে কিছু বিকৃত রুচির মানুষের কারণে।’ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. হেদায়েতুল ইসলাম বাংলাদেশ  প্রতিদিনকে বলেন, ‘সাধারণত যাদের অ্যাগ্রেসিভ টেনডেনসি বেশি তারা কোনো কিছু চিন্তা না করে আরেকজনের ক্ষতি করে। ইন্টারপারসোনালিটি কনফ্লিক্ট থেকেই মানুষ এ ধরনের অপরাধ করে।’ সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা : পরপর দুই কন্যাসন্তান জন্ম হওয়ায় পুত্রসন্তান-প্রত্যাশী বাবা বদিউজ্জামান দুই কন্যার মধ্যে ছোটটিকে গলা টিপে হত্যা করেন। সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার মুকন্দগাতী গ্রামের তাঁতশ্রমিক বদিউজ্জামান গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি তার নয় মাস বয়সী মেয়েকে গলা টিপে হত্যার পর তার লাশ একটি ডোবায় ফেলে দিয়ে পালিয়ে যান। চলতি বছরই যশোরে ঈদ উপলক্ষে নতুন পোশাক কিনে দিতে না পেরে দুই শিশু সন্তানকে বিষ খাইয়ে হত্যার পর সেই শিশুদের মা হামিদা খাতুন আত্মহত্যা করেন। গত ২৭ মে শার্শা উপজেলার চালিতাবাড়িয়ার দীঘা গ্রামে এ ঘটনা। হামিদা খাতুনের স্বামী ইবরাহিম পেশায় চা বিক্রেতা। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় ১০ টাকা চাওয়ায় গত ১৫ অক্টোবর কাউছার (৭) নামে এক শিশুকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন তার মা স্বপ্না বেগম। এজন্য শিশুটির মা স্বপ্না বেগমসহ আরও চারজনকে পুলিশ আটক করেছে। কাউছারের বাবা রাসেল পিকআপ ভ্যানচালক। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার নন্দলালপুরে গত ১৪ অক্টোবর একটি বাড়ির চতুর্থ তলার ছাদ থেকে দেড় বছরের আশফাক জামান জাহিন নামে একটি শিশুকে ছুড়ে ফেলে তার মা রোকসানা হত্যা করেন।

রোকসানাকে পুলিশ গ্রেফতার করে। কিন্তু রোকসানা মানসিক ভারসাম্যহীন বলে তার পরিবারের সদস্যরা দাবি করছেন। সম্প্রতি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় শিশু তুহিনকে তার বাবা ও চাচা নৃশংসভাবে খুন করেছেন। সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেন। জানা যায়, প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে তুহিনের বাবা নিজ সন্তানকে হত্যায় অংশ নেন। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘মা-বাবার তাদের শিশু হত্যাকান্ডে র ঘটনাগুলো যারা ঘটাচ্ছেন তারা প্রত্যেকেই আর্থিক ও শারীরিকভাবে আরেক ব্যক্তির সঙ্গে জড়িত। এ ধরনের সম্পর্কে হত্যাকারী অভিভাবকদের অনেকেই পরকীয়ায় জড়িত থাকেন। সাধারণত এসব সম্পর্কে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে বিয়ে বা অর্থের জন্য চাপ দেয় আর কোনো কারণে বাধা পেলে হিংসার বশবর্তী হয়ে আপন সন্তানকেও হত্যা করতে দ্বিধা করে না।’

সর্বশেষ খবর