রবিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভয়ঙ্কর অতিথি

মির্জা মেহেদী তমাল

ভয়ঙ্কর অতিথি

সন্ধ্যায় নামাজ শেষে বিশ্রাম নিচ্ছেন ফেন্সি। কখন যে তার চোখ লেগে আসে টেরই পাননি। কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভাঙে। কলিংবেলের শব্দে তার বুক ধড়ফড় করে। বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছা করছিল না। আবারও কলিংবেল। দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন রাত সাড়ে ৮টা। অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিছানা থেকে উঠতে হচ্ছে তাকে। বিড়বিড় করে বলছিলেন, এমন সময় আবার কে এলো! দরজা খুলেই ফেন্সি দেখতে পেলেন দুই তরুণ সামনে দাঁড়ানো। অ্যাডভোকেট জহির সাহেব কি বাসায় আছেন? বিনয়ের সঙ্গে এক তরুণ প্রশ্ন রাখল ফেন্সির কাছে। জহির সাহেব মানে জহিরুল ইসলাম। ফেন্সির স্বামী। পেশায় আইনজীবী। তার খোঁজেই এসেছে দুই তরুণ। ফেন্সি তাদের ভালো করে লক্ষ্য করেন। নাহ. আগে কখনো দেখেননি তাদের। তবে দেখাশোনায় খুব ভদ্র প্রকৃতির মনে হলো ফেন্সির কাছে। না, উনি তো বাসায় নেই। কী ব্যাপার বলুন, আমি উনাকে বলে দেব। ফেন্সি জবাব দেন। দরজায় দাঁড়িয়ে তরুণদের একজন বলে, আমরা এসেছি একটি জরুরি কাজে। আমরা বিদেশ যাব। বিদেশ যাওয়ার কাগজপত্র অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলামকে দেখাতে এসেছি। ফেন্সি তাদের বলেন পরদিন আসতে। আগে থেকে বলে রাখবেন তিনি তার স্বামীকে। এ কথা শুনে তরুণরা বলল, ঠিক আছে অসুবিধা নেই। পরদিনই তারা আসবে। এ সময় দুই তরুণের একজন হঠাৎ বলে, আমরা মেডিকেল কলেজের স্টুডেন্ট। আপনাদের বাসার ওয়াশরুমটা কি একটু ব্যবহার করা যাবে? এ কথা শুনে ফেন্সি তাদের বলেন, অবশ্যই। আসুন আপনারা। এ কথা বলেই ফেন্সি ওয়াশরুম দেখিয়ে দেন। একজন ওয়াশরুমে চলে যায়। আরেকজন বসে থাকে ড্রইংরুমে। ওয়াশরুম থেকে তরুণ বেরিয়ে এলে ফেন্সি বলেন, আপনারা নাস্তা করুন। আসুন ডাইনিং টেবিলে। দুই তরুণ ইতস্তত করতে থাকে। ফেন্সি বলেন, আরে আসেন, আমার মেয়েও মেডিকেল কলেজে পড়ে। এ কথা-সে কথা বলতে বলতে তারা ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসে। তাদের চা বিস্কিট দেওয়া হয়। তাদের আরও আপ্যায়ন করতে ফেন্সি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি ফ্রিজ থেকে খাবার বের করতে থাকেন। রান্নাঘরে যান। পানি আনেন। আবার ফ্রিজ খোলেন। এ সময়ই দুজনের একজন হাতে একটি বড় তালা নেয়। পেছন থেকে ফেন্সির মাথার সজোরে আঘাত করে। ফেন্সি সঙ্গে সঙ্গে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়েন। ছটফট করতে থাকেন ফেন্সি। রক্তে মেঝে ভাসতে থাকে। এরপর দুজনে মিলে তালা দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকে। মাথা থেঁতলে যায়। টেবিলে থাকা ফল কাটার ছুরি দিয়ে মাথায় আরও কয়েকটি আঘাত করে। তারা ফেন্সির মৃত্যু নিশ্চিত করতে পলিথিন দিয়ে মুখ চেপে ধরে। ছটফট করতে থাকা ফেন্সির দেহ একসময় নিথর হয়ে পড়ে। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর দুই তরুণ ওয়াশরুমে যায়। তাদের শরীরে লাগা ফেন্সির রক্ত ধুয়েমুছে পরিষ্কার হয়ে নেয়। এরপর বেরিয়ে যায় দুই তরুণ। তারা ওই বাসা থেকে কোনো মালামাল লুট করেনি। অচেনা দুই অতিথিকে ঘরে ঢুকিয়েই জীবনের বিনিময়ে চরম খেসারত দিলেন চাঁদপুরের ফেন্সি। ফেন্সির পুরো নাম শাহিন সুলতানা ফেন্সি। চাঁদপুরের একটি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। গত মাসে এ নৃশংস ঘটনাটি ঘটে। তার স্বামী চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী জহিরুল ইসলাম।

এ হত্যাকান্ডে র ঘটনায় পুলিশ রাকিবুল হাসান ও লিমন নামে সেই দুই তরুণকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে পুলিশ খুনের এ ঘটনা জানতে পারে। রাকিবুল হাসান আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। সে জহিরুল ইসলামের দ্বিতীয় স্ত্রী জুলেখা বেগমের চাচাতো ভাই ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ছাত্র। তাকে ঢাকা থেকে আটক করা হয়। রাকিব জবানবন্দিতে জানিয়েছে, হত্যাকান্ডে তার সঙ্গে আরেক চাচাতো ভাই লিমনও অংশ নেয়। তাদের উভয়ের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ফতেহপুর পশ্চিম ইউনিয়নে।

পুলিশ জানিয়েছে, জহিরের দ্বিতীয় স্ত্রী জুলেখাই ফেন্সি হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী। ঘটনার পর পুলিশ জুলেখার যে মোবাইল ফোন জব্দ করেছিল, তার কললিস্টে ঘটনার দিন রাকিব ও লিমনের সঙ্গে জুলেখার একাধিকবার কথা বলার প্রমাণ ছিল। এর সূত্র ধরেই গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তাদের শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। জানা গেছে, ঘটনার দিন সকালে এ দুই যুবকের একজন ঢাকা থেকে আরেকজন মতলব উত্তর থেকে চাঁদপুর আসে। এরপর তারা শহরের হাসান আলী সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠসহ বিভিন্ন স্থানে বৈঠক করে খুনের পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনামতো ইফতারের পরপরই কিলিং মিশনে অংশ নেয়।

তবে জবানবন্দিতে রাকিব জুলেখার কথা বললেও আইনজীবী জহির সম্পর্কে কিছু বলেছে কিনা, তা জানা যায়নি। পুলিশ জানায়, ফেন্সি হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আটক ব্যক্তির জবানবন্দি আমরা নিয়েছি। এতে এ হত্যাকা- পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে আইনজীবী জহির ও তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সম্পৃক্ততার বিষয়ে আমাদের কাছে যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত আছে। আমরা চাই এর সঠিক তদন্ত শেষে এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত প্রকৃত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে।’ গত ৪ জুন ঘটনার রাতেই জহিরুলকে দ্বিতীয় স্ত্রী জুলেখাসহ শহরের নাজিরপাড়ার ভাড়া বাসা থেকে আটক করে ডিবি পুলিশ। ৫ জুন ফেন্সির ভাই মো. ফোরকান উদ্দিন খান জহির, জুলেখাসহ চারজনের বিরুদ্ধে চাঁদপুর মডেল থানায় হত্যা মামলা করেন। অন্য দুই আসামি জহিরের ছোট ভাই নয়ন ও বোন রানু।

পুলিশের বক্তব্য, একজনের ক্ষতিতে সবার শিক্ষা হওয়া উচিত। ফেন্সি মারা গেছেন তার এক ভুলের কারনে। তিনি অচেনা কোনো অতিথিকে ঘরের ভিতর না ঢোকালে হয়তো এমন ঘটনা নাও ঘটতে পারত। তাছাড়া আরও মস্ত ভুল করেছে জহিরুলের দ্বিতীয় স্ত্রী জুলেখা। হয়তো তার ধারণা ছিল, প্রথম স্ত্রীকে হত্যা করতে পারলেই তার জীবন সুন্দর হবে। কিন্তু আইনের হাত অনেক লম্বা। তাকে এখন সুখের বদলে থাকতে হবে দুঃখের মধ্যে। তার সামনে এখন শুধুই ফাঁসির দড়ি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর