শুক্রবার, ১ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
কেমন আছেন সাভারবাসী ৬

মানবসেবায় সিআরপি

বছরে চিকিৎসাসেবা পান ১ লাখ রোগী

মোস্তফা কাজল, সাভার থেকে ফিরে

মানবসেবায় সিআরপি

বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ব্যক্তি চিকিৎসাসেবা পান সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের একমাত্র চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র ‘সিআরপি’ থেকে। এ প্রতিষ্ঠান পক্ষাঘাতগ্রস্ত প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে সমাজের মূলধারায় একীভূত করার জন্য ১৯৭৯ সালের ১১ ডিসেম্বর থেকে কাজ করছে। ৪০ বছরে প্রায় ৪০ লাখ রোগীকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ব্রিটিশ স্বেচ্ছাসেবী ও ফিজিওথেরাপিস্ট মিস ভেলরি এ টেইলরের নেতৃত্বে রাজধানীর উপকণ্ঠে সাভার পৌর এলাকায় এটি অবস্থিত। এ প্রতিষ্ঠান রেজিস্ট্রেশন অর্জন করে ’৮১ সালে। দুস্থ মানবতার ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে ভেলরি অ্যান টেইলর  স্বদেশ, স্বজন ও নিজস্বার্থ ত্যাগ করে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা ইতিহাসে দুর্লভ। ভেলরি টেইলরকে প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশকে এ কাজের জন্য কেন বেছে নিলেন? তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত আমি। দরিদ্রতা, অসহায়ত্ব ও চিকিৎসার অভাবের কারণেই এ দেশকে বেছে নেওয়া হয়েছে।’ সমাজের সুবিধাবঞ্চিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সিআরপির সেবা কার্যক্রম সমগ্র দেশে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সরকারি-বেসরকারি, দেশি-বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের আন্তরিক সহযোগিতায় প্রধান কার্যালয় সাভার সিআরপিসহ ১৩টি সাব-সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রধান কার্যালয়ে চিকিৎসার জন্য ১০০ শয্যা রয়েছে। মিরপুরের উপকেন্দ্রেও রয়েছে সমসংখ্যক শয্যা। সম্প্রতি প্রতিটি বিভাগে কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা বিভাগে সেবা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সিআরপিতে সেবা গ্রহণকারীর বেশির ভাগ দরিদ্র শ্রেণির মানুষ। এ হাসপাতাল থেকে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলার অনেক ব্যক্তি চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। সাভারবাসীর জন্য এ হাসপাতাল আশীর্বাদস্বরূপ মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ দেশে সিআরপির যাত্রার সময় ভেলরির সঙ্গে সহযোগী ছিলেন একজন দেশীয় ফিজিওথেরাপিস্ট, একজন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট ও একজন সমাজকর্মী। প্রায় চার দশক আগে ‘সার্ভিস টু সাফারার্স ইজ সার্ভিস টু গড’ স্লোগান নিয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের একটি পরিত্যক্ত সিমেন্টের গোডাউনে মাত্র চারজন রোগী নিয়ে শুরু হয় সিআরপির কার্যক্রম। দেশ-বিদেশে প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সেবার একটি আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এই অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের প্রতিবন্ধীদের সামগ্রিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করছে। চিকিৎসাধীন সময় এবং পরবর্তীতে রোগীদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তার নিরিখে যথাযথ চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সেবা প্রদানই সিআরপির কাজ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যানমতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগ প্রতিবন্ধী। এর এক বিরাট অংশ মেরুরজ্জুতে আঘাত পেয়ে শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার হচ্ছে। বিশেষ করে স্ট্রোক রোগী ও সেরিব্রাল পালস শিশু। ১৯৬৯ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের চন্দ্রঘোনায় ভিএসও নামের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় একজন ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে স্বল্পকালীন চুক্তিতে এ দেশে আসেন যুক্তরাজ্যের ‘মেম্বার অব চার্টার্ড সোসাইটি অব ফিজিওথেরাপি-এমসিএসপি’ সনদধারী মিস ভেলরি এ টেইলর। ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার দুই মাস আগেই বাংলাদেশে ফিরে আসেন। মানবতার কল্যাণের জন্য মাতৃভূমিও তাকে মায়ার বাঁধনে বাঁধতে পারেনি। ’৭২ সালে এ দেশের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করার জন্য ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে একজন ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে ড. আর জে গাস্টের সঙ্গে কাজ শুরু করেন।

 তিনি অনুভব করেন পক্ষাঘাতগ্রস্তদের মধ্যে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে চরম হতাশাজনক অবস্থা বিরাজ করছে। কেননা তাদের জন্য নামমাত্র চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও পুনর্বাসনের কোনো বন্দোবস্ত ছিল না।

 এরই ধারাবাহিকতায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগী নিয়ে যাত্রা হয়। তাকে রোগীদের নিয়ে ধানমন্ডির শংকরে একটি ভাড়াবাড়িতে উঠতে হয়। পরে সেখান থেকে ফার্মগেটে তৎকালীন এম আর খান ভবনে (বর্তমানে পারটেক্স ভবন) আসেন। রোগীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকলে প্রয়োজন হয়ে পড়ে একটি স্থায়ী অবস্থানের। প্রথম ১১ বছর বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসাসেবা দিয়ে ’৯০ সালে সাভারে ১৩ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় সিআরপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। প্রতিবন্ধীদের জন্য তার মূল্যবান অবদানের জন্য ব্রিটেনের রানী তার বিশেষ খেতাব ‘অর্ডার অব ব্রিটিশ এমপায়ার’ প্রদান করেছেন। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের মানবকল্যাণের জন্য ১৯৬৬ সালে তিনি হল্যান্ডের ওয়ার্ল্ড অর্থোপেডিক কনসার্ন প্রদত্ত আর্থার আয়ার ব্রুক স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। বাংলাদেশের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে বিশেষ ভূমিকা রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সরকার তাকে সম্মানজনক নাগরিকত্ব প্রদান করে। এ ছাড়া তিনি স্বাধীনতা পদক (২০০৪), জাতীয় সমাজসেবা পদক (২০০০), ডা. এম আর খান ও আনোয়ার ট্রাস্ট স্বর্ণপদক (২০০০), খান বাহাদুর আহছান উল্লাহ স্বর্ণপদক (২০০৮), মহাত্মা গান্ধী শান্তিপদক (২০০৯), যুক্তরাজ্যের ইয়র্ক সেন্ট জন ইউনিভার্সিটি থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রিসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর