শুক্রবার, ১ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

নিম্নমানের সিলিন্ডারে তৈরি হচ্ছে হাইড্রোজেন গ্যাস

ঘটছে ভয়াবহ দুর্ঘটনা

বিশেষ প্রতিনিধি

তদারকিবিহীন নিম্নমানের গ্যাস সিলিন্ডারে বিপজ্জনকভাবে গ্যাস ব্যবহারের কারণেই ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটছে। মেয়াদোত্তীর্ণ এসব সিলিন্ডারের মূল কাঠামো পরিবর্তন করে ব্যবহার করা হচ্ছে। বুধবার রাজধানীর মিরপুরে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আট শিশুর মৃত্যুর ঘটনা তারই দৃষ্টান্ত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। মূলত সিলিন্ডারের ভিতরেই হাইড্রোজেন তৈরি করে বেলুনে গ্যাস ভরা হচ্ছিল। সিলিন্ডারটিও ছিল নিম্নমানের। এতে সিলিন্ডার ফেটে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটে। এ ধরনের গ্যাস তৈরি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ বলে জানিয়েছে বিস্ফোরক পরিদফতর। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সাধারণত শিশুদের ব্যবহৃত বেলুনে নিরাপদ হিলিয়াম গ্যাস ব্যবহার করার কথা। কিন্তু বেলুন বিক্রেতারা হিলিয়াম গ্যাসের পরিবর্তে হাইড্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করছেন। এ গ্যাস উৎপাদন প্রক্রিয়াটিও অত্যন্ত বিপজ্জনক। বিস্ফোরক পরিদফতরের প্রধান পরিদর্শক সামসুল আলম বলেন, ‘এটি আসলে সিলিন্ডার নয়, গ্যাস প্রডিউসিং রিঅ্যাক্টর। গ্যাস সিলিন্ডারকে পরিবর্তন করে সিলিন্ডারের ভিতরেই হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরি করার পদ্ধতি বানানো হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘সিলিন্ডারের ভিতরে কস্টিক সোডা ও অ্যালুমিনিয়াম পাউডার দিয়ে হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরি করা হয়। এর সাহায্যে বেলুন ফোলাতে থাকে। এর মধ্যে কিছুক্ষণ ফোলানোর পর কোনো কাস্টমার না থাকলে সাধারণত সিলিন্ডারের নবটি বন্ধ করে রাখা হয়। এই সময়ও সিলিন্ডারের ভিতরে হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরি হতে থাকে। এতে সিলিন্ডারের ওপর গ্যাসের চাপ বাড়তে থাকে। আর তাতে ভিতরে ক্ষয় হতে থাকে। একপর্যায়ে গ্যাসের চাপ বেশি বেড়ে গেলে সিলিন্ডারটি গরম হয়ে নরম হয়ে যায়। এ অবস্থায় যখন আবার বেলুনে গ্যাস ভরার জন্য নব খোলা হয়, তখনই বিস্ফোরণ ঘটে।’

প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক আরও বলেন, ‘এ ধরনের রিঅ্যাক্টর একেবারে নিষিদ্ধ। এ ধরনের সিলিন্ডার যার কাছে পাওয়া যাবে তাকেই পুলিশের ধরা উচিত। পুলিশ প্রশাসনকে আমরা বহুবার চিঠি দিয়ে এ বিষয়টি জানিয়ে সহায়তা চেয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘আইন অনুযায়ী কোনো কারখানায় হাইড্রোজেন তৈরি হলে যথাযথ সিলিন্ডারে ভরে তা সরবরাহ করতে হবে। সিলিন্ডার থেকে বেলুন ফোলাতে হবে। তারা তা না করে সরাসরি সিলিন্ডারের ভিতরেই হাইড্রোজেন তৈরি করে, যা খুবই বিপজ্জনক।’ এদিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক সুলতানা রাজিয়া বার্তা সংস্থা বিবিসিকে বলেন, ‘সাধারণত বেলুনে হিলিয়াম গ্যাস ব্যবহার করার কথা। এ গ্যাস ব্যবহারে বিপদও কম। কিন্তু আজকাল বেলুন বিক্রেতারা হিলিয়াম গ্যাসের পরিবর্তে হাইড্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করছেন।’ তিনি বলেন, ‘গ্যাস ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সিলিন্ডার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সিলিন্ডারের মান ভালো না থাকায় প্রায়ই সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। যে সিলিন্ডারের ভিতরে হাইড্রোজেন গ্যাস থাকে সেখান থেকে যদি গ্যাস নির্গত হয় তাহলে বিস্ফোরণের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু হিলিয়াম গ্যাস থাকলে বিপদ ততটা থাকে না।’

উল্লেখ্য, গত বুধবার রাজধানীর মিরপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ছয় শিশুর মৃত্যুর পর গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিহাদ (৮) নামে আহত আরেক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এর আগে ২৫ জানুয়ারি রাজধানীর মিরপুর-১-এর শিক্ষা বোর্ড ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে বেলুন ফোলানোর সময় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে সিদ্দিক (৩৭) নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির সময় এ ঘটনা ঘটে। ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর পাবনার ঈশ্বরদীতে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে পাঁচ শিশুসহ ছয়জন দগ্ধ হয়। ঈশ্বরদী উপজেলায় আয়োজিত উন্নয়ন মেলা মাঠে এ দুর্ঘটনাটি ঘটে। সাধারণত শহর ও গ্রামের পথে-ঘাটে ভ্যানে করে গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে বেলুন বিক্রির দৃশ্য প্রায়ই চোখে পড়ে। এসব বেলুন দেখে শিশু-কিশোরদের প্রবল আকর্ষণ তৈরি হয়। গ্যাস সিলিন্ডার-ভর্তি ভ্যানের দিকে তারা ছুটে যায়। কিন্তু এই গ্যাস সিলিন্ডার যে কোনো সময় ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে।

বুয়েটের অধ্যাপক সুলতানা রাজিয়া আরও বলেন, ‘রাস্তাঘাটে যেভাবে সিলিন্ডারে গ্যাস ভরে বেলুন বিক্রি করা হচ্ছে সেদিকে অবশ্যই নজর দিতে হবে। এসব সিলিন্ডার থেকে হাইড্রোজেন গ্যাস লিকেজ হলে বিস্ফোরণ ঘটে। তাই সব ধরনের উচ্চচাপের গ্যাস সিলিন্ডার সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করা উচিত।’

 

সর্বশেষ খবর