শুক্রবার, ১ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
সিলিন্ডার বিস্ফোরণ

মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৭, আহতদের নিয়েও শঙ্কা পরিবারের

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর রূপনগরে অবস্থিত প্রতিভা স্কুলের প্লে শ্রেণির ছাত্র মিজান (৬)। ক্লাস শেষ করে কোচিংয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফেরার পথে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মারাত্মক আহত হয় সে। তার স্থান হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) ৯ নম্বর বেডে। বিস্ফোরণে তার পেটের ভুঁড়ি বেরিয়ে গেছে। ঘটনার পর থেকে মিজান অচেতন রয়েছে। দুই ভাইয়ের মধ্যে সে বড়। ছোট ভাই মেহেদীর বয়স তিন বছর। চিকিৎসকরা বলছেন, মিজানের অবস্থা আশঙ্কাজনক। মিজানের বাবা মনিপুর স্কুলের ভ্যানচালক। মিজানের বাবা রোকন মিয়া ও মা মিনা বলেন, ‘বিস্ফোরণে ছেলের পেটের ভুঁড়ি বের হয়ে গেছে। বুধবার রাতেই অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। এর পর থেকে আইসিইউতে। তার চিন্তায় আমাদেরও ঘুম হারাম।’ তাদের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ি থানার সাতগাঁওয়ে। বর্তমানে তারা রূপনগরের ১১ নম্বর রোডে মজিবরের বস্তিতে থাকেন। রূপনগরে এডাফ স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. সিয়াম। এ মাসের ১৭ তারিখ তার প্রাথমিক স্কুল সার্টিফিকেট (পিইসি) পরীক্ষা। বুধবার বিকালে কোচিং শেষে ১১ নম্বর রোডের মনিপুর স্কুলের পাশ দিয়ে বাসায় ফিরছিল। এ সময় বিকট শব্দে বিস্ফোরণে কিছু একটা তার গায়ে লাগে। মুহূর্তেই তার চোখ, মুখ, হাত ও পা ঝলসে যায়। স্বজনরা তাকে উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করেন। বর্তমানে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন সিয়াম। ১৭ তারিখ পরীক্ষা হলেও এতে সে অংশ নিতে পারবে কি না তা নিয়ে চিন্তিত তার পরিবার। চিকিৎসকরা বলছেন, আগুনে সিয়ামের শরীরের ৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাকে এখনই আশঙ্কামুক্ত বলা যাচ্ছে না। ঠিক একই সময় বাজার থেকে পেঁপে আর মুরগি কিনে বাসায় ফিরছিলেন জান্নাত। কিন্তু জান্নাতের ঠিকানা এখন ঢামেক হাসপাতালে। বিস্ফোরণে তার ডান পা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। নার্সারি পড়ুয়া মেয়ে সুমাইয়া মুরগি দিয়ে ভাত খেতে চেয়েছিল। আহাজারি করে এমনটাই বলছিলেন জান্নাত। গৃহকর্মীর কাজ শেষে মেয়ের জন্য মুরগি আর পেঁপে কিনে বাসায় ফিরছিলাম। রঙিন বেলুন দেখে ভ্যানের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। তখনই সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে। হাসপাতালে দেখি আমার একটি পা বিচ্ছিন্ন।’ শুধু মিজান, সিয়াম, জান্নাত নয়, তাদের মতো ১৭ জন আহত হয়েছে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায়। সাতজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আহতদের চিন্তায় স্বজনদের ঘুম হারাম। সুস্থ হলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে কি না এসবই এখন তাদের ভাবিয়ে তুলছে। ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. মোহাম্মদ আলাউদ্দিন জানান, দুজনের অবস্থা একটু বেশি খারাপ। তবে সবাইকে সারিয়ে তুলতে তারা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। এদিকে গতকাল ভোরে ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আট বছরের নিহার উদ্দিন মারা গেছে। তাকে নিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭। ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া জানান, বিস্ফোরণের পরপরই নিহারকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। তার চোখে ও মাথায় আঘাত লেগেছিল। নিহত নিহার নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থানার সরোয়ার হোসেন সরুর ছেলে। সে রূপনগর বস্তিতে ব্র্যাক স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র ছিল। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে ছোট নিহার। গতকাল ঢামেক মর্গে নিহারের মা হালিমা বেগম বলেন, ‘বেলুনওয়ালাকে দেখে নিহার আমার কাছে এসে বেলুন কেনার টাকা চায়। ১৫ টাকা দিলে খুশিতে বেলুন কিনতে চলে যায়। এর কিছুক্ষণ পরই বিকট আওয়াজ শুনে গিয়ে দেখি আমার বাপজান রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।’

বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহারসহ নিহত অন্য ছয়জনের লাশ গতকাল ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। নিহত অন্যরা হলো ভোলার চরফ্যাশন থানার দুলারহাট উপজেলার নুর ইসলামের ছেলে রুবেল (১২), একই উপজেলার ও একই বাড়ির নুর আলমের মেয়ে নূপুর (৭), ভোলা সদরের আবু তাহেরের মেয়ে ফারজানা (৭), রোকন মিয়ার ছেলে রিফাত (৮), নেত্রকোনার আটপাড়ার মিলনের মেয়ে রিয়ামণি (৮) ও কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের মো. আলমের ছেলে রমজান (১১)। নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে এবং আহত সাতজনকে ৫ থেকে ১৫ হাজার করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।

এদিকে ঘটনার মূল হোতা সেই বেলুনওয়ালা আবু সাঈদকে প্রথমে শনাক্ত করা সম্ভব না হলেও বুধবার রাত ১১টার দিকে তার সন্ধান পায় পুলিশ। ঘটনার পর কেউ তাকে উদ্ধার করে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাকে গ্রেফতারের পর ঢামেক হাসপাতালে এনে ভর্তি করা হয়েছে। রূপনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ জানান, এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে বুধবার রাতে রূপনগর থানায় একটি মামলা করেছে। মামলায় ওই বেলুনবিক্রেতাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।

ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি বেলুনবিক্রেতা আবু সাঈদ জানান, তার বাড়ি চুয়াডাঙ্গায়। ঢাকায় রূপনগরের পাশে দুয়ারীপাড়ায় একটি মেসে থাকেন। ১০ বছর টেইলার্সে কাজ করেছেন। কিন্তু ১৫ দিন ধরে তিনি ভ্যানে করে বেলুনে গ্যাস ঢুকিয়ে বিক্রি করছিলেন। ওই দিন গ্যাস শেষ হওয়ার পর সাদা ছাইজাতীয় কিছু এবং আরেকটা কেমিক্যাল সিলিন্ডারের ভিতরে দিয়ে তিনি ঝাঁকি দেন। ঠিক তখনই বিস্ফোরণ ঘটে। তার দাবি, ছাইজাতীয় পাউডার ও ওই কেমিক্যালের নাম তিনি জানেন না। কিন্তু কীভাবে গ্যাস তৈরি করা হয় তা তিনি শিখেছেন। বিস্ফোরণে তার বাঁ হাতের কব্জি পর্যন্ত থেঁতলে এবং পেট ও বাঁ রান ঝলসে গেছে। 

বুধবার সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতাহতের পরপরই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন বিস্ফোরক পরিদফতরের কর্মকর্তারা। প্রাথমিক তদন্তে তারা বলেন, কস্টিক সোডা ও অ্যালুমিনিয়াম পাউডার দিয়ে হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরির করার সময় সিলিন্ডারটির বিস্ফোরণ ঘটে। হাউড্রোজেন গ্যাস তৈরির পদ্ধতি জানলেও হয়তো এর ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতেন না বেলুনবিক্রেতা।

এদিকে গতকাল দুপুরে আহতদের দেখতে ঢামেক হাসপাতালে যান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম। এ সময় এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর