শনিবার, ২ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

বাসের কারণেই বিশৃঙ্খল সড়ক

জয়শ্রী ভাদুড়ী

বাসের কারণেই বিশৃঙ্খল সড়ক

সময় দুপুর সাড়ে ১২টা। ক্লাস শেষে বাসের জন্য ফুটপাথে অপেক্ষা করছেন শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থীরা। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে অপেক্ষমাণ যাত্রী দেখে প্রতিযোগিতায় নামে জাবালে নূর পরিবহনের দুটি বাস। রাস্তা ছেড়ে ফুটপাথে পথচারীদের ওপর দানবের মতো উঠে আসে গাড়ি। চাকায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেয় মারা যান দুজন শিক্ষার্থী। গত বছরের ২৯ জুলাই এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের মুখে পাস হয় সড়ক পরিবহন আইন।

জানা যায়, গতকাল থেকে কার্যকর হয়েছে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮। কিন্তু আইন কার্যকর হলেও নির্দিষ্ট লেনে চলছে না রাজধানীর বাসগুলো। সব সময় চলছে প্রতিযোগিতা। শুধু অন্য কোম্পানির বাস নয়, একই কোম্পানির বাসের মধ্যে দেখা মেলে তীব্র প্রতিযোগিতার। অধিকাংশ বাসের ছালবাকল উঠে গেছে অন্য বাসের সঙ্গে ঘেঁষাঘেঁষি করতে গিয়ে। ভেঙে গেছে হেডলাইট, ব্যাকলাইট, লুকিং গ্লাসও। এ প্রতিযোগিতায় গত বছরের ৩ এপ্রিল হাত হারান তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব হোসেন। বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের দুটি বাসের ধাক্কাধাক্কিতে হাত কাটা পড়ার ১৩ দিন পর মারা যান রাজীব। বাসের বেপরোয়া চলাচলে সড়কে অসংখ্য প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও সমাধান মেলেনি। রাজধানীজুড়ে বাস স্টপেজ নির্ধারণ করে দিয়েছে ট্রাফিক বিভাগ। কিন্তু স্টপেজে না দাঁড়িয়ে যেখানে সেখানে বাস থামিয়ে চলছে যাত্রী ওঠানো-নামানো। রাস্তার মাঝখানে নামিয়ে দেওয়া হয় যাত্রীদের। অন্য বাস যেন আগে গিয়ে যাত্রী তুলতে না পারে এজন্য রাস্তার মাঝে বাঁকা করে বাস থামান চালকরা।

সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট)  অধ্যাপক সামছুল হক বলেছেন, ‘রাজধানীর গণপরিবহন ব্যবস্থাপনায় নজর না দিলে সড়কে কখনো শৃঙ্খলা ফিরবে না। শুধু আইন পাস করলে হবে না, মনিটরিং বাড়াতে হবে। গণপরিবহন ব্যবস্থাপনায় পৃথিবীর সব দেশ একদিকে হাঁটছে আর আমরা অন্যদিকে।’ গত বুধবার রাজধানীর নতুন বাজার থেকে উত্তরা যাওয়ার পথে প্রতিযোগিতা শুরু করে রাইদা পরিবহনের দুটি বাস। কুড়িল ফ্লাইওভারে উঠেও চলে ওভারটেক প্রতিযোগিতা। ফ্লাইওভার থেকে নেমে খিলক্ষেতে যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতায় প্রবল বেগে গা ঘেঁষে যায় পেছনের বাসটি। চালকের ডান পাশের লুকিং গ্লাস ভেঙে চলে যায় ওই গাড়ির সঙ্গে। এরপর শুরু হয় দুই বাসের কর্মীদের হাতাহাতি। ফ্লাইওভারের মুখে বাস থামিয়ে চলছে যাত্রী ওঠানো-নামানো। মহাখালী ফ্লাইওভারের জাহাঙ্গীর গেট প্রান্তে দ্রুতগতিতে গাড়ি ওঠানামা করছে। এর মাঝেই এয়ারপোর্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউ পরিবহন ফ্লাইওভারের মুখে দাঁড়িয়ে যাত্রী নামাচ্ছে। ফ্লাইওভারের শুরুর এই জায়গা থেকে যাত্রী তুলতে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নামতে দেখা যায় চালকদের। জাহাঙ্গীর গেটের সিগন্যাল পার হতেই দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে এসে চালকরা হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়েন ফ্লাইওভারের মুখে। এখানে বাস থামানো নিষেধসংবলিত সাইনবোর্ড থাকলেও তা মানছেন না কেউ। এভাবে যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতায় প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। হঠাৎ ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ায় পেছনে থাকা দ্রুতগতির গাড়িগুলো দুর্ঘটনার মুখে পড়ছে। এ ব্যাপারে নগর বিশ্লেষক স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘শুধু বাসগুলো নির্দিষ্ট লেনে চললে রাজধানীর যানজট বিশৃঙ্খলা ৬০-৭০ ভাগে কমিয়ে আনা সম্ভব। যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতায় সড়কে ঝরছে প্রাণ। মোটরসাইকেল চালকদের এলোমেলো চলাচলে দুর্ঘটনা আরও বেড়েছে। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধে উদ্যোগ নিয়েছিলেন মেয়র আনিসুল হক। ৫-৬টি কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়ে রুট নির্ধারণ করে সড়কে বাস নামালে বিশৃঙ্খলা অনেকটা কমে আসবে।’

 মোবাশ্বের হোসেন আরও বলেন, ‘আইন কার্যকরে চালক, যাত্রী ও সড়ক ব্যবহারকারীদের সজাগ হতে হবে। কেউ আইন ভাঙলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীর সংখ্যাও বাড়াতে হবে। মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলে সমাধান মিলবে না।’

সর্বশেষ খবর