শনিবার, ২ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ওরা বিকালের সচিব

মির্জা মেহেদী তমাল

ওরা বিকালের সচিব

অফিসের সময় শেষ। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অফিস ছাড়তে শুরু করেছেন। কিছু সময়ের মধ্যেই প্রাণচাঞ্চল্যের এই অফিসে নেমে আসে নীরবতা। কিন্তু তখন সেখানেই শুরু হয় আরেক অফিস। গুটিকয় মানুষ তাদের পোশাক পরিবর্তনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সাধারণ পোশাক ছেড়ে গায়ে জড়িয়ে নেন দামি কোট, গলায় বাঁধেন টাই। চাঞ্চল্য ফিরে পায় নির্দিষ্ট কিছু কক্ষে। দিনের বেলায় এই মানুষেরই কাজ ছিল সেই কক্ষের তালা খুলে দেওয়া। অফিস শেষে তালা লাগিয়ে বাসায় ফেরা। কিন্তু তারা তালা না লাগিয়ে নিজেরাই হয়ে ওঠেন অফিসের প্রধান কর্তা, বিকালের সচিব। এদের কাছে ফাইল আসে। ফাইলে সই দেন। তবে এসব ফাইল শুধু চাকরি প্রার্থীদের। অন্য কোনো ফাইলে তারা স্বাক্ষর করেন না। বিনিময়ে তারা চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে আদায় করেন মোটা অঙ্কের টাকা।

এ দৃশ্য প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র খোদ বাংলাদেশ সচিবালয়ের। সচিবালয়ের ভিতরেই সক্রিয় চাকরিদাতা প্রতারকচক্রের সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। বহিরাগত দালাল ছাড়াও এ চক্রে জড়িত সচিবালয়েই কর্মরত চতুর্থ শ্রেণির কিছু কর্মচারী। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই চক্রের সদস্যদের শনাক্ত করেছে। বেশ  কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। এরা অফিসের সময় শেষ হয়ে গেলে যখন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সচিবালয় ছাড়েন, তখন তাদেরই কক্ষে শুরু হয় প্রতারকদের ‘অফিস’! কখনো উপ-সচিবের কক্ষে, কখনো যুগ্ম সচিবের কক্ষেÑ কর্মকর্তাদের চেয়ারে বসেই প্রতারকরা চাকরিপ্রার্থীদের ইন্টারভিউ নেওয়ার নামে নাটক করছেন এবং বিভিন্ন দফতরে চাকরি দেওয়ার নাম করে প্রতারণা করে আসছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, প্রতারকচক্রে জড়িত অন্যদের ধরতে চলছে অভিযান। প্রবেশ পথ থেকে চাকরি প্রত্যাশীদের সচিবালয়ের ভিতরে নিয়ে যেতেন পিয়ন কেএম মোর্তুজা আলী রনি। কক্ষের ভিতরে কখনো উপ-সচিব বা যুগ্ম সচিব সেজে বসে থাকেন ফরাশ শাখায় কর্মরত মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম। যদিও চতুর্থ শ্রেণির এই দুই কর্মচারীর আসল কাজ কর্মকর্তাদের কক্ষের তালা খোলা ও বন্ধ করা। এরা ধাপে ধাপে প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ, ভুয়া নিয়োগপত্র প্রদান ও পদায়নের নির্দেশপত্র তুলে দিয়ে জনপ্রতি ১০ থেকে ১৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। পরে, যোগদানের জন্য চাকরি প্রত্যাশীদের ডেকে নিয়ে সার্ভিস ও বেতন বই খোলা হয়। নেওয়া হয় আঙ্গুলের ছাপ। এক মাস পর দেওয়া হয় বেতন। এরপর, আর মাইনে পান না চাকরি প্রত্যাশীরা। ধীরে ধীরে প্রতারণার জালে আটকে নাভিশ্বাস ওঠে তাদের। এমনই এক ভুক্তভোগী মুসলেহ উদ্দিন। প্রতারণার শিকার হওয়া মুসলেহ উদ্দিন বলেন, আমি সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি। আমার ছোট বোনের জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে এই চক্রটি। এই করুণদশার জন্য সচিবালয়ে পিয়ন পদে কর্মরত প্রতারকদের একটি সংঘবদ্ধ চক্র দায়ী। তিনি বলেন, পিয়ন সচিব সেজে, সচিবের চেয়ারে বসে, রাষ্ট্রীয় খাম, রাষ্ট্রীয় প্যাড ব্যবহার করে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। আমি চাই এর সুষ্ঠু বিচার হোক এবং আমরা আমাদের টাকাগুলো ফেরত পাই।

সম্প্রতি প্রতারক চক্রের ৩ সদস্যের বিরুদ্ধে চলতি বছর সেপ্টেম্বরে মিরপুর থানায় মামলা করেছেন মুসলেহ উদ্দিন। গ্রেফতার হন শাহিনুল কাদির সুমন, যিনি সরকারি চাকরি প্রত্যাশীদের জোগাড় করে সচিবালয়ে কর্মরত প্রতারকদের হাতে তুলে দেন। এরই মধ্যে প্রতারক চক্রের অন্যতম সদস্য পিয়ন শফিকুল ইসলামকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। আরেক অভিযুক্ত প্রতারক পিয়ন কে এম মোর্তুজা আলী রনি আত্মগোপনে। ঘটনা অনুসন্ধানে কাজ শুরু করেছে ৩ সদস্যের সরকারি তদন্ত কমিটি।

সুমন ও তার সহযোগীর বিরুদ্ধে মাগুরার সদর আমলি (ক) আদালতেও একটি মামলা হয়েছে। মামলাটি করেছেন জনৈক শাখাওয়াত হোসেন। বাদীর অভিযোগ, তার ছেলেসহ ৮ জনকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দফতরে অফিস সহকারী ও অফিস সহায়ক পদে চাকরি দেওয়ার নাম করে তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে ৭৯ লাখ টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক উপসচিবের স্বাক্ষর জাল করে হুবহু নিয়োগপত্রের আদলে তাদেরও দেওয়া হয়েছিল ভুয়া ‘নিয়োগপত্র’।

র‌্যাব জানিয়েছে, ৬-৭ বছর ধরে প্রতারণা করে আসছে চক্রটি। এ পর্যন্ত পঞ্চাশ জনের বেশি ভুক্তভোগীর খোঁজ মিলেছে। এ বিষয়ে র‌্যাব-৪ এর কর্মকর্তা বলেন, পিয়ন বা এমএলএসএস পদে কর্মরত আছে এমন ব্যক্তিরা বড় বড় কর্মকর্তা সেজে স্বাক্ষর জাল করে ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা করে। ইন্টারভিউয়ের পর, তাদের আরেক ব্যক্তির কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। যারা একহাতে নিয়োগপত্র দেন আরেক হাতে টাকা লেনদেন করেন। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজ নিজ বিভাগ যদি তাদের কর্মচারীদের ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে সরকারি কর্মচারী কর্তৃক প্রতারণার বিষয়টি অনেকটাই কমে যাবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর