মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হচ্ছে জানুয়ারিতে

জিন্নাতুন নূর, পটুয়াখালীর কলাপাড়া থেকে ফিরে

পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হচ্ছে জানুয়ারিতে

দেশের সর্ববৃহৎ ও সর্বাধুনিক পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসছে আগামী বছরের জানুয়ারিতে। বাংলাদেশ  ও চীনের যৌথ বিনিয়োগে তৈরি হওয়া প্রকল্পটির পূর্ণ উৎপাদনে না এলেও এর দুই ইউনিটের একটি বছরের শুরুতে উৎপাদনে আসছে। সে ক্ষেত্রে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ২০২০ সালের জানুয়ারির ১৫ তারিখে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে বলে নিশ্চিত করেছে বিদ্যুৎ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। সর্বশেষ ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে প্রকল্পের ৯১ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এখন শুধু বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ৪০০ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন নির্মাণ শেষ হলেই বিদ্যুৎ বিভাগের অন্যতম বড় এই প্রকল্পটি ব্যবসায়িকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাবে। আর সে ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বিভাগ কর্তৃপক্ষও আশা করছে, আগামী বছরের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে উপস্থিত থেকে দেশের সর্ববৃহৎ কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উদ্বোধন করবেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, পৃথিবীতে এ ধরনের উন্নত প্রযুক্তির বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ সাধারণত ১০ বছরের আগে শেষ হওয়ার নজির নেই। কিন্তু বাংলাদেশে মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই এর নির্মাণকাজ শেষ করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশিদের এ ধরনের পাওয়ার প্লান্ট পরিচালনা করার পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় কেন্দ্রটি পরিচালনার জন্য ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। তারা পাঁচ বছর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনার পাশাপাশি জনবলও প্রশিক্ষণ দেবে। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধানখালী ইউনিয়নের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের জ্বালানি হচ্ছে আমদানিকৃত কয়লা। এরই মধ্যে প্রকল্প এলাকায় ইন্দোনেশিয়া থেকে উৎপাদিত কয়লাবাহী জাহাজ ভিড়তে শুরু করেছে। ২৮ অক্টোবর ইন্দোনেশিয়া থেকে ২০ হাজার টন আমদানিকৃত কয়লার প্রতি হাজার টনের মূল্য ৫৫ ডলার। আর এই মূল্যে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হবে ৭.৫ সেন্ট বা ৬ টাকা ৩৬ পয়সা। জানা যায়, এই প্রকল্পের ৬৬০ মেগাওয়াটের এক ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন হবে সাড়ে ছয় হাজার টন কয়লা। আর ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা লাগবে ১৩ হাজার টন। তবে সংশ্লিষ্টরা জানান, এই কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দামের সঙ্গে ওঠানামা করবে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দামের ওপর ভিত্তি করেই এর বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ নির্ধারিত হবে। প্রকল্প এলাকায় মোট ছয়টি কয়লার ডোম হবে, যেখানে দুই মাসের সমপরিমাণ কয়লা মজুদ রাখার ব্যবস্থা থাকবে। অর্থাৎ কখনো নাব্যতা সংকটে কয়লাবাহী জাহাজ আসতে সমস্যা হলেও কয়লার অভাব হবে না। প্রকল্প এলাকায় পরিদর্শনে গিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, ‘নির্ধারিত সময় অনুযায়ী চলতি বছরের এপ্রিলে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনে যাওয়ার কথা ছিল। তবে জুন মাসে উৎপাদনে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ব্যাক ফিড পাওয়ার ও এভাকিউশনের কারণে উৎপাদনে আসা সম্ভব হয়নি। তবে সর্বশেষ কাজের অগ্রগতি অনুযায়ী মোটামুটিভাবে নিশ্চিত যে জানুয়ারির ১৫ তারিখে আমরা উৎপাদনে যেতে পারব। প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ করতে আমাদের যে খুব বেশি দেরি হয়েছে তা বলা যায় না। বিদ্যুতের ট্রান্সমিশন লাইনগুলো ১০০ থেকে ১৫০ কিমি পর্যন্ত লম্বা। আবার এ লাইন যে জমির ওপর দিয়ে টানা হয় তা নিয়েও কিছু জটিলতা থাকে। এ জন্য কাজ শেষ হতে কিছুটা সময় লাগছে।’ তিনি জানান, এই প্রকল্প পরিচালনার জন্য এরই মধ্যে দেশীয় কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা হয়েছে। তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিপিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এম খোরশেদুল আলম জানান, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রয়োজনীয় সব অবকাঠামো নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। এখন শুধু গ্রিড লাইন নির্মাণের অপেক্ষা। ৪০০ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন নির্মাণ হলে কিছু পরীক্ষা শেষে কেন্দ্রটি উৎপাদনে যাবে। ডিসেম্বরের মধ্যে এই লাইন নির্মাণ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ওই সময় একটি ইউনিট (৬৬০ মেগাওয়াট) পূর্ণ উৎপাদনে আসবে বলে তিনি আশাবাদী। প্রকল্পটির পরিচালক শাহ আবদুল মাওলা বলেন, ‘বর্তমানে প্রকল্পের শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে। এ মুহূর্তে আমাদের কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার পর্যাপ্ত প্রস্তুতি আগে থেকেই নিতে হবে, যা এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। এ কেন্দ্রে যে বিনিয়োগ করা হয়েছে তাতে কাক্সিক্ষত পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলে অর্থ উঠে আসবে না। আবার নদীর নাব্যতা না থাকায় আমরা চাহিদার বিপরীতে পর্যাপ্ত কয়লা আমদানি করতে পারছি না, যা সরাসরি বিদ্যুতের উৎপাদন খরচে প্রভাব ফেলবে।’ প্রকল্পটি নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনের সাউথ এশিয়ান রিজিওনাল সেন্টারের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার কি উয়ে বলেন, ‘বেশি দূরত্বের কারণে বর্তমানে ট্রান্সমিশন লাইন নির্মাণে কিছু জটিলতা আছে। আর এ লাইনটি নির্মাণ হলেই আমরা জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারব। আমরা প্রকল্পটিতে চীনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আধুনিক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। আর এই প্রযুক্তি পরিবেশবান্ধব, যা স্থানীয় মানুষের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলবে না।’

বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প : এ প্রকল্প এলাকায় বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে গত এক বছরে টাওয়ার বসিয়ে সেই এলাকার বাতাসের গতিবিধি পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে চীনে এই ডাটা পাঠিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যাচাই-বাছাই শুরু করেছে। বিদ্যুৎ বিভাগ সেই ফিজিবিলিটি রিপোর্টের ভিত্তিতে এরই মধ্যে প্রকল্প এলাকায় ৫০ মেগাওয়াটের বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য টারবাইন বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি নির্মাণে দুই বছর সময় লাগবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর