শনিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

প্রবাসে যত হয়রানিতে নারী কর্মীরা

আরও সতর্কতার সঙ্গে পাঠানোর পক্ষে বিশেষজ্ঞরা

জিন্নাতুন নূর

প্রবাসে গিয়ে কষ্টের আয়ে যে নারী শ্রমিক বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখছেন সেই শ্রমিকরাই বিদেশে গিয়ে শিকার হচ্ছেন অমানবিক নির্যাতনের। কপাল ফেরাতে বিদেশ পাড়ি দিলেও নারী শ্রমিকরা দেশে ফিরছেন লাশ হয়ে। নির্যাতিত যেসব নারী কোনোরকমে মালিকের অত্যাচার থেকে পালিয়ে দেশে ফিরে আসছেন তাদের শরীরেও নির্যাতনের ছাপ স্পষ্ট। দেশে ফিরে এসব শ্রমিকের কেউ কেউ তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ যৌন নির্যাতনের বিষয়ে মুখ খুললেও লজ্জায় মুখ বন্ধ রাখেন অনেকেই। চলতি বছরের ১০ মাসে নানা রকম নির্যাতনের শিকার হয়ে ৯৫০ জন নারী শ্রমিক সৌদি আরব থেকে ফিরে এসেছেন। আবার এই বছরেরই প্রথম ১০ মাসে দেশে ফিরেছে ১১৯ জন নারী শ্রমিকের লাশ। বিদেশে নারী কর্মীদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এ ঘটনা সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের সামনে বারবার তুলে ধরা হলেও অবস্থার উন্নতি হয়নি। এ অবস্থায় সম্প্রতি জাতীয় সংসদেও বিদেশে নারী শ্রমিকদের না পাঠানোর জোর দাবি উঠেছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোও বিষয়টি নিয়ে এখন বেশ চিন্তিত। বিদেশে কাজ করতে যাওয়া বাংলাদেশি নারী শ্রমিকদের তিন ভাগের একভাগই যান সৌদি আরবে। এ ছাড়াও নারী শ্রমিকরা জর্ডান, ওমান, কাতারসহ বেশ কয়েকটি দেশে কাজ করতে যান। এসব দেশে মূলত তাদের গৃহকর্মী হিসেবে পাঠানো হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌদি আরবসহ বেশ কিছু দেশে সরকার নারীদের শুধু গৃহকর্মী হিসেবে পাঠাচ্ছে। কিন্তু নতুন বাজারে দক্ষ নারী শ্রমিক পাঠানোর বিষয়ে সরকারকে এবার উদ্যোগ নিতে হবে। এতে বিদেশে পাঠানো নারী শ্রমিকের সংখ্যা কিছুটা কমে গেলেও চিন্তার কিছু নেই। মূলত সৌদিসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে নারী শ্রমিকরা অমানবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বিষয়টি দূতাবাস ও সরকারকে জানানো হলেও তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। অথচ শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া এমনকি পাকিস্তানের নারীদের নির্যাতনের অভিযোগ আছে এমন দেশে পাঠানো বন্ধ রেখেছে দেশগুলোর সরকার। 

এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের (বিএমইটি) দেওয়া তথ্যে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদেশে কাজ করতে গেছেন ৪ লাখ ৭০ হাজার ২৬৫ জন নারী শ্রমিক। যা ১৯৯১ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত পরিসংখ্যান হিসেবে সর্বোচ্চ। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরব, ওমান ও কাতার এই তিনটি দেশে যথাক্রমে ২ লাখ ৬৮ হাজার ১১২ জন, ৫৩ হাজার ৯৮১ এবং ৪৪ হাজার ৬৮৪ জন নারী কর্মী গেছেন। আবার চলতি বছরের মে মাসে সৌদিতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নারী শ্রমিক যান কিন্তু নির্যাতনের কারণে সেপ্টেম্বরে আবার নারী শ্রমিক গমনের হার কমে আসে। ২০১৮ সালে অনলাইনে শ্রমিকরা যেসব অভিযোগ করেন তার মধ্যে শুধু সৌদি আরব থেকেই শ্রমিকদের ১৭৮টি অভিযোগ আসে। ব্র্যাক মাইগ্রেশনের তথ্যে, চলতি বছরের ১০ মাসে ৯৫০ জন নারী শ্রমিক সৌদি আরব থেকে ফিরে এসেছেন। বিদেশে কাজ করতে যাওয়া ৪৮ নারীর মৃতদেহ দেশে এসেছে সৌদি আরব থেকে। তবে প্রবাসী কল্যাণ ডেক্সের তথ্যে, বিগত কয়েক মাসে দেশে ফিরেছেন ১ হাজার ২৫০ জন কর্মী। ২০১৬ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত বিদেশ থেকে লাশ হয়ে দেশে ফিরেছে ৩৯০ জন নারী শ্রমিক। চলতি বছর প্রথম ১০ মাসেই দেশে এসেছে ১১৯ নারী শ্রমিকের লাশ। নারী কর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সৌদি আরব, জর্ডান, লেবানন ওমান ও আরব-আমিরাতে মৃত্যু ঘটছে। নিয়োগ কর্তার মাধ্যমে যৌন নির্যাতন, অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণের জন্য আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়াও অতিরিক্ত কাজের চাপ ও মানসিক যন্ত্রণার ফলে স্ট্রোকজনিত কারণেও তাদের মৃত্যু হচ্ছে। জানা যায়, কাজ করতে গিয়ে নারীরা গড়ে ১৮ ঘণ্টার পরিশ্রম শেষে তিন বেলা খেতে পান শুধু শুকনো রুটি। এসব কারণে সম্প্রতি নারী শ্রমিকদেরও সৌদি আরবে যাওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহ কমেছে। গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেন, বিদেশে নারী শ্রমিক পাঠানো নিয়ে ঝামেলায় আছে সরকার। একদিকে নারী শ্রমিকদের অত্যাচারের বিভিন্ন ঘটনা ঘটছে, অন্যদিকে দেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করায় বিদেশে নারী শ্রমিক পাঠানো নিয়ে বিপাকে আছে সরকার। তবে বিদেশে নারী শ্রমিক না পাঠানোর বিষয়ে সরকার এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। তিনি আরও বলেন, নারী কর্মীরা নির্যাতিত হলে তাদের শেল্টার হোমে রাখা হয়। তাদের বলা হয়, তারা অভিযোগ করলে মামলা করা হবে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা অভিযোগ করতে চান না। তবে দেশে ফিরলে তারা অভিযোগ করেন, তাদের অত্যাচার করা হয়েছে।

কিছু দিন আগে সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদও নারী শ্রমিকদের নির্যাতিত হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি নারী শ্রমিকরা যাতে সম্মানজনকভাবে বিদেশে কাজ করতে পারেন। আর যদি একেবারেই না করতে পারেন তাহলে তাদের না পাঠানোর চিন্তা করব। অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন সংস্থার (ওকাপ) একটি গবেষণা বলছে, ফেরত আসা নারী কর্মীদের ৬১ শতাংশ নানা ধরনের শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। ১৪ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হন। ৫২ শতাংশ নারীকে জোরপূর্বক দীর্ঘ সময় কাজে বাধ্য করা হয়। আর নির্যাতনের কারণে অসুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আসেন ৬৩ শতাংশ নারী। ৮৬ শতাংশকে ঠিকমতো বেতন দেওয়া হয় না। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চের (রামরু) তথ্যে, সৌদি আরবের সেফ হোমে এখনো অনেক নারী দেশে ফেরার অপেক্ষায়। শারীরিক নির্যাতনের ছাপ নিয়ে বহু নারী কর্মী দেশে ফিরেছেন। তবে বেশির ভাগ নারী কর্মী অভিযোগ করেন, তাদের ওপর বাড়ির মহিলা কর্ত্রী শারীরিক অত্যাচার করতেন।

রামরুর চেয়ারম্যান ড. তাসনিম সিদ্দিকী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সৌদি আরবে নারী শ্রমিকদের ওপর যে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে তাতে অনেক শ্রমিক বিদেশে যেতে ভয় পাচ্ছে। নারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গিয়ে বিদেশ গমনে নারী শ্রমিকদের সংখ্যা কিছুটা কমেও যায় এতে চিন্তার কোনো কারণ নেই। সরকারকে বরং শুধু গৃহকর্মী হিসেবে নারীদের বিদেশে না পাঠিয়ে নতুন বাজারে দক্ষ নারী শ্রমিক কীভাবে পাঠানো যায় সেটি দেখতে হবে।

সর্বশেষ খবর