শনিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ড্রাইভিং শিক্ষায় নৈরাজ্য

১২ হাজার টাকায় লাইসেন্স, কারোরই নেই অফিস

জয়শ্রী ভাদুড়ী

রাজধানীর কাকলী মোড় থেকে বনানীর দিকে যেতে দেয়ালে লেখা রয়েছে ড্রাইভিং শেখানো হয়। যোগাযোগের জন্য শুধু মোবাইল নম্বর দেওয়া রয়েছে। এ নম্বরে যোগাযোগ করলে সজল নামে এক ব্যক্তি বলেন, তাদের কোনো অফিস নেই। উত্তরা দিয়াবাড়ীতে তারা ড্রাইভিং শেখান। ১২ হাজার টাকা দিলে পাস-ফেলের চিন্তা ছাড়াই ড্রাইভিং লাইসেন্স পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তারা। একই পরিস্থিতি উত্তরায় অবৈধভাবে গড়ে তোলা ড্রাইভিং স্কুলগুলোরও। আজমপুরের রবীন্দ্রসরণিতে রয়েছে এ টু জেড মোটর ড্রাইভিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) নিবন্ধন ছাড়াই চলছে এসব ড্রাইভিং স্কুল। ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক শহিদুল ইসলাম সাগর বলেন, নিবন্ধন নেওয়া অনেক ঝামেলার তাই নিই না। আমি ১৫ বছর ধরে স্কুল চালাই। শেখানোর পাশাপাশি বিআরটিএ থেকে আমরা ড্রাইভিং লাইসেন্সও করে দিই। আমাদের লোক আছে। শুধু ১৩ হাজার টাকা দিলেই চলবে। এসব অবৈধ ড্রাইভিং স্কুলের প্রশিক্ষকদের অনেকেরই ড্র্রাইভিং লাইসেন্স নেই। হালকা গাড়ি চালানোর লাইসেন্স থাকলেও ভারী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স কারোরই নেই। উত্তরা, মহাখালী, বনানী এলাকার পাঁচটি স্কুল ঘুরে দেখা গেছে এই চিত্র। বিআরটিএ’র নিবন্ধনের তালিকায় দেখা যায়, দেশজুড়ে বিআরটিএ’র নিবন্ধিত স্কুল রয়েছে  ১৩৪টি। এর মধ্যে ঢাকায় রয়েছে ৭৮টি এবং ঢাকার বাইরে ৫৬টি। ঢাকায় বিআরটিসির ড্রাইভিং স্কুল রয়েছে ১০টি, রানার ড্রাইভিং ট্রেনিং সেন্টারের ৫টি, শ্যামলী আইডিয়ালের ৪টি, সোয়েবস ওয়ান স্কুল অব ড্রাইভিংয়ের ২টি, মুসলিম এইড ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের ২টিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নামে বাকিগুলোর নিবন্ধন রয়েছে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর ৩০-৩৫ হাজার চালকের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু অনুমোদিত ড্রাইভিং স্কুলগুলো থেকে প্রতিবছর প্রশিক্ষিত হচ্ছেন তিন-পাঁচ হাজার চালক। বাকি চালক কীভাবে তৈরি হচ্ছেÑ এ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। চালকের এই চাহিদা মেটাতেই একের পর এক গড়ে উঠছে অবৈধ ড্রাইভিং স্কুল। ড্রাইভিং স্কুল চালু করতে বিআরটিএর অনুমোদন পাওয়ার শর্তে উল্লেখ আছে, প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব জায়গা থাকতে হবে, লাইসেন্সধারী প্রশিক্ষক, প্রশিক্ষণ উপযোগী ভালো মানের যানবাহন এবং যথাযথ উপকরণ থাকতে হবে। কিন্তু বেশির ভাগ স্কুলের নিজস্ব কোনো জায়গা নেই। অথচ বিআরটিএ থেকে তারাও অনুমোদন পাচ্ছে। শুরুতে বিআরটিএ থেকে লাইসেন্সধারী প্রশিক্ষকদের দেখিয়ে অনেক স্কুল অনুমোদন নিলেও পরে তাদের দেখা পাওয়া যায় না। তখন ড্রাইভিং জানা যে কাউকে বানানো হয় প্রশিক্ষক। প্রশিক্ষকদের লাইসেন্স পাওয়ার জন্য ভারী যানবাহন চালানোর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং এসএসসি পাসের নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। বিআরটিএ’র নাকের ডগায় দেদার এই অবৈধ স্কুলের জমজমাট ব্যবসা চললেও নেই কোনো তদারকি। বিআরটিএ পত্রিকার মাধ্যমে নোটিস দিয়ে সব অবৈধ স্কুলকে শর্ত পূরণ সাপেক্ষে লাইসেন্স নিতে প্রায়ই নির্দেশনা দেয়। তা না করলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়। কিন্তু বিজ্ঞপ্তি পর্যন্তই বিআরটিএ যেন তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছে। এ ব্যাপারে বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান ড. মো. কামরুল আহসানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। অবৈধ ড্রাইভিং স্কুলের বিষয়ে সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যে কোনো ব্যক্তি ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন করলে প্রশিক্ষককে সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। তাহলে অবৈধ স্কুলের আর কোনো সুযোগ থাকে না। কিন্তু আমাদের দেশে সর্বস্বীকৃত এই মডেলের বাইরে গিয়ে লাইসেন্স দিয়ে দেওয়া হয়। কে, কোথায়, কার কাছে, কীভাবে শিখছে তার কোনো তথ্যই নেয় না বিআরটিএ। আমরা ভুল পদ্ধতি প্রয়োগ করে সড়ককে বিশৃঙ্খল করে তুলছি। এসব অদক্ষ চালকের জন্য আরও অনিরাপদ হয়ে উঠছে সড়ক। এই সুযোগে ব্যবসা করে নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।

সর্বশেষ খবর