বুধবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

এটিএম বুথে যেভাবে জালিয়াতি

১১ সেকেন্ডেই ‘ডঙ্গল ডিভাইস’ সংযোগ । পূবালী ব্যাংক থেকে দুই দিনে তুলে নেওয়া হলো ৯ লাখ ৭৭ হাজার টাকা

সাখাওয়াত কাওসার

এটিএম বুথে যেভাবে জালিয়াতি

আবারও এটিএম বুথে ভয়াবহ জালিয়াতি! এবার প্রতারক চক্রের থাবা পড়েছে রাজধানীর বাইরে। গত ১৬ ও ১৭ নভেম্বর কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে পূবালী ব্যাংকের তিনটি বুথ থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে ৯ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। চলতি বছরের ১ জুন ইউক্রেনের সাত নাগরিকের ভয়াবহ এটিএম জালিয়াতির কোনো কিনারা করা যায়নি। এর মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় জালিয়াতির পুনরাবৃত্তি চোখ কপালে উঠিয়ে দিয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার। তিনটি বুথের ফুটেজে দুই ব্যক্তির চেহারা দেখা গেছে। দুর্বৃত্তরা যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে সেজন্য ছবিগুলো এরই মধ্যে সবকটি বিমান, স্থল ও সমুদ্রবন্দরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৬ নভেম্বর কুমিল্লা সদরের মেইন ব্রাঞ্চের এটিএম বুথ থেকে ৬টা ৫ মিনিটে শুরু হয় প্রতারক চক্রের অপারেশন। চলে ৬টা ১৯ মিনিট পর্যন্ত। কিছু সময় বিরতি দিয়ে আবার ৬টা ৩৫ মিনিট থেকে ৬টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত দুই দফায় মোট ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা তুলে নেয় প্রতারকরা। ফুটেজ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মাত্র ১১ সেকেন্ডের মধ্যে এটিএম মেশিন খুলে ডঙ্গল ডিভাইস সংযোগ করে কালো-লাল রঙের ফুল হাতা শার্ট ও কালো ফ্রেমের চশমা পরিহিত এক যুবক। মেইন সার্ভার থেকে মুহূর্তেই বিচ্ছিন্ন করে দেয় ওই এটিএম বুথকে। ‘এন্টার’ বাটন টিপে শুরু করে টাকা উত্তোলন। প্রতিটি ট্রানজেকশনে ২০ হাজার টাকা উঠিয়ে নেয়। নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে একবার ৩-৪ মিনিটের জন্য বাইরে আসে ওই প্রতারক। পরে আবারও শুরু হয় টাকা উত্তোলন। দুই দফায় মিলিয়ে মোট ২৫ মিনিট চলে তার অপারেশন। এ ব্যাপারে গতকাল সন্ধ্যায় কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানায় অজ্ঞাতদের নামে মামলা দায়ের করেছেন ওই শাখার ম্যানেজার এ জি এম মইনুল ইসলাম।

১৭ নভেম্বর চট্টগ্রাম ডবলমুরিং থানা এলাকার কলেজ রোডের পূবালী ব্যাংক ব্রাঞ্চের এটিএম বুথে ৬টা ৩৯ থেকে ৬টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত চলে দুই প্রতারকের টাকা উত্তোলন অভিযান। এবার আগের যুবকের সঙ্গে অংশ নেয় আকাশি রঙের শার্ট ও বাদামি রঙের প্যান্ট এবং চশমা পরিহিত মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি। ছয় মিনিটের অপারেশনে ওরা হাতিয়ে নেয় ৩ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। মুজিব রোডের ব্রাঞ্চে রাত ৮টা ৪৪ মিনিট থেকে ৯টা ৩ মিনিট পর্যন্ত ১৯ মিনিটের অভিযানে হাতিয়ে নেওয়া হয় ৩ লাখ ১০ হাজার টাকা। এখানেও অংশ নেয় দ্জুন।

জানা গেছে, ২০১২ সালের ডিসেম্বরে এটিএম সেবা শুরু করে পূবালী ব্যাংক। কারিগরি সেবা নিশ্চিত করছে টেকনো মিডিয়া লি.। যুক্তরাষ্ট্রের এনসিআর ব্র্যান্ডের বাংলাদেশি এজেন্ট টেকনো মিডিয়া লি.। মেশিনগুলো ভারতে রি-অ্যাসেম্বলড করা। বর্তমানে দেশের প্রায় বিভিন্ন এলাকায় ১৭৩টি এটিএম বুথের মাধ্যমে সেবা দিচ্ছে তারা। পূবালী ব্যাংকের হেড অব কার্ড ডিভিশন অসীম কুমার রায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। টাকাগুলো ব্যাংকের মূল অ্যাকাউন্ট থেকেই খোয়া গেছে। এতে কোনো গ্রাহক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন না। বিষয়টি নিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও কাজ করছে।’ চলতি বছরের ১ জুন সন্ধ্যায় রাজধানীর খিলগাঁও তালতলা এলাকার ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের একটি বুথ থেকে অভিনব পদ্ধতিতে জালিয়াতি করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার সময় স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় ইউক্রেনের এক নাগরিককে আটক করে পুলিশ। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওইদিন রাতেই পান্থপথের হোটেল ওলিও ড্রিম হ্যাভেনে অভিযান চালিয়ে ইউক্রেনের আরও পাঁচ নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলো ভ্যালেনটাইন (পাসপোর্ট নম্বর ইওয়াই ০৫১৫৬২), ওলেগ (পাসপোর্ট নম্বর ইএক্স ০৮৯৯৬৩), ডেনিস (পাসপোর্ট নম্বর এফএল ০১৯৮৩৪), নাজেরি (পাসপোর্ট নম্বর এফটি ৫০০৫০১), সারগি (পাসপোর্ট নম্বর এফএইচ ৪২৪৩৯৪) ও ভোলোবিহাইন (পাসপোর্ট এফটি ৩৭৯৯৮৩)। অভিযানের বিষয় টের পেয়ে ভিতালি (পাসপোর্ট নম্বর এফই ৮০৪৪৪৮) নামে এক ইউক্রেনিয়ান পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটি জালিয়াতি মামলা ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পক্ষ থেকে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে একটি মামলা করা হয়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সূত্রে জানা গেছে, ১ জুনের ঘটনায় পালিয়ে যাওয়া ইউক্রেনের নাগরিক ভিতালিকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (পূর্ব) শাহিদুজ্জামান রিপন বলেন, ‘কেবল ভিতালিকেই গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তবে জালিয়াত চক্রের কাছ থেকে উদ্ধার করা এটিএম কার্ডের আদলে তৈরি কার্ডগুলো ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে জালিয়াতির কৌশলও জানার চেষ্টা চলছে। কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের ঘটনায় জড়িতদের আমরা খুঁজছি। একই সঙ্গে কারও কাছে এ বিষয়ে কোনো তথ্য থাকলে তা দিয়ে কিংবা ভিডিও ফুটেজে থাকা ব্যক্তিদের শনাক্তকরণে আমাদের সহায়তা করার অনুরোধ জানাচ্ছি।’ তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, জুনের ঘটনায় প্রতারক চক্রটি ‘টুপকিন’ নামে একটি ম্যালওয়ার ব্যবহার করেছিল। টাকা উত্তোলনের সময় পুরো প্রক্রিয়াটি ইউক্রেন থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। তবে এ চক্রটিকে ধরতে ইউক্রেন থেকে তেমন সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। জালিয়াতির ঘটনার পর পুলিশ ওই সময়ে ইউক্রেন থেকে আসা বিদেশি নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ করে। ওই সময় পুলিশ জানতে পারে ইউক্রেন থেকে আরেকটি প্রতারক দল ঢাকায় এসে জালিয়াতি করে টাকা তুলে নিয়ে যায়। সন্দেহভাজন ওই তিন নাগরিক হলো শেরি, রোমান ও দিমিত্রি। তাদের আসা-যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেলেও বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া এই চক্রটির সঙ্গে বাংলাদেশি এক তরুণের বিমানবন্দরে কথা বলার কিছু ফুটেজ পাওয়া গেছে। ওই ফুটেজ দেখেও তাকে শনাক্ত করা যায়নি। এটিএম জালিয়াতির ঘটনায় ইউক্রেনের এ চক্রটির সঙ্গে বাংলাদেশি একটি চক্র জড়িত রয়েছে বলে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। সর্বশেষ কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে পূবালী ব্যাংকের তিনটি বুথে টাকা জালিয়াতির ঘটনায় ফুটেজে থাকা দুই ব্যক্তি এ চক্রেরই সদস্য বলে তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রের ধারণা। অন্যদিকে, সিআইডির এক সূত্র জানান, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ মামলার তদন্ত করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে এফবিআইয়ের একটি টিমের সঙ্গে বৈঠকও করেছে সিআইডি। তবে জালিয়াত চক্রের সব সদস্যকে এখনো শনাক্ত করা যায়নি। একটি সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘এরা আন্তর্জাতিক জালিয়াত চক্রের সদস্য। ফুটেজে থাকা ব্যক্তিদের দেখে বোঝা যাচ্ছে এরা সাউথ এশিয়ান। এদের ছবি গুরুত্বপূর্ণ সব পয়েন্টে দেওয়া হয়েছে।’ পুলিশ সদর দফতরের সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক সোহেল রানা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পূবালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে এখনো কোনো অভিযোগ না পেলেও পুলিশ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। আমরা বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি।’

সর্বশেষ খবর