বুধবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

গ্যাস সিলিন্ডার না মৃত্যুদূত!

জিন্নাতুন নূর

গৃহস্থালি, যানবাহন ও বাণিজ্যিকে গত কয়েক বছরে দেশে সকল প্রকার গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে বাজারে সব কোম্পানি মান বজায় না রাখায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দুর্ঘটনা এবং এতে হতাহতের সংখ্যাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। ফায়ার সার্ভিস, তিতাস গ্যাস, বিস্ফোরক পরিদফতরের তথ্যমতে, গত এক দশকে সারা দেশে গ্যাস বিস্ফোরণ-সংক্রান্ত বিভিন্ন দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৫০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। চলতি বছর নভেম্বর পর্যন্ত নিহত হয়েছেন শতাধিক, আহত প্রায় ২০০ জন। সব মিলিয়ে দৈনন্দিন ব্যবহার্য গ্যাস সিলিন্ডার এখন মৃত্যুদূতে পরিণত হয়েছে।

বিস্ফোরক পরিদফতরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ব্যবহারকারীর অসচেতনতায় বেশির ভাগ সিলিন্ডার দুর্ঘটনা ঘটছে। সিলিন্ডারের সঙ্গে থাকা নিম্নমানের হোস পাইপ, রেগুলেটরসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। চলতি বছরে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে শুধু রাজধানীর পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডিতে প্রাণ হারিয়েছেন ৮১ জন। ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে তিনজন, এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গ্যাসের লাইন বিস্ফোরণে দুজন, অক্টোবরে রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে বেলুন বিক্রির সময় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে সাত শিশু ও মানিকগঞ্জে একই পরিবারের তিনজন নিহত হন। সর্বশেষ ১৭ নভেম্বর চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় নিহত হন সাতজন। বিস্ফোরক পরিদফতর বলছে, গত ১০ বছরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ-সংক্রান্ত নয় শতাধিক দুর্ঘটনায় দেড় হাজার মানুষ হতাহত হয়েছেন। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে বছরে গড়ে পাঁচ-ছয়টি বড় ধরনের ঘটনা ঘটছে। বিস্ফোরণে বছরে গড়ে নিহত হন ৫০-৬০ জন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, সারা দেশ থেকে মাসে আগুনে পোড়া ৫০০ পীড়িত ব্যক্তি সেখানে ভর্তি হন। এর এক-পঞ্চমাংশেরই মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ৪০ শতাংশই গ্যাসের আগুনে দগ্ধ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ক্রস ফিলিংয়ের মাধ্যমে এলপিজির ব্যবসা চলছে। আবার বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান মান বজায় রেখে সিলিন্ডার তৈরি করছে না। কিছু ক্ষেত্রে বিস্ফোরক পরিদফতর কার্যকর মনিটরিং করতে পারছে না। এজন্য এলপিজি ব্যবসায়ীরা এ খাতের তদারকি বাড়াতে এবং হয়রানি দূর করতে সরকারের কাছে পৃথক একটি ‘এলপিজি সেল’ গঠনের দাবি জানিয়েছেন। এলপিজি ব্যবসায়ীরা জানান, বাসাবাড়িতে এলপিজি সিলিন্ডার রাখতে আলাদা কোনো স্থান রাখা হয় না। আমাদের বিল্ডিং কোডে এ বিষয়ে উল্লেখ থাকতে হবে। এ ছাড়া এ ধরনের দুর্ঘটনার জন্য অনেক সময় নিম্নমানের চুলাও দায়ী। দুর্ঘটনা কমাতে তারা সিলিন্ডারের গায়ে বাংলায় ব্যবহার নির্দেশিকা লিখে রাখার পরামর্শও দেন। এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (লোয়াব) সভাপতি আজম জে চৌধুরী বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে অনেক প্রতিষ্ঠানকে এলপিজি ব্যবসার জন্য লাইন্সেস দেওয়া হচ্ছে কিন্তু তাদের সক্ষমতা আছে কিনা তা যাচাই করে দেখা হচ্ছে না। পথেঘাটে বাল্ক এলপিজি দিয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিলিন্ডারে এলপিজি ভর্তি করছে, এতেও দুর্ঘটনা ঘটছে। ক্রস ফিলিংয়ের মাধ্যমে অবৈধভাবে সিলিন্ডারে গ্যাস ভরা হলেও বিস্ফোরক পরিদফতর তা মনিটর করছে না।’ বিস্ফোরক পরিদফরের সূত্রমতে, আবাসিক, শিল্প ও বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য দেশে প্রায় ৯০ লাখ এলপিজি সিলিন্ডার আছে। যানবাহনে ব্যবহৃত সিএনজি সিলিন্ডার আছে প্রায় ৬ লাখ। রিটেস্টের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার এলপিজি ও ৩০০ সিএনজি সিলিন্ডার বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত রিটেস্ট সুবিধা না থাকায় ঝুঁকি বাড়ছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, ‘সিলিন্ডার দুর্ঘটনা রোধে প্রতি ঘরে ডিটেকটর লাগানো যেতে পারে। এতে গ্যাস লিক হলে তা বের করা সম্ভব।’

সাধারণত একটি গ্যাস সিলিন্ডারের আয়ু সর্বোচ্চ ১৫ বছর। এই সময় পার হলেই সেই সিলিন্ডারের বিস্ফোরিত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। কিন্তু দেশে ব্যবহৃত সিলিন্ডারগুলোর ক্ষেত্রে এই বিধিনিষেধ মানা হয় না। দেশে সিএনজিচালিত যানবাহনের সংখ্যা সোয়া ৫ লাখ। নিয়ম অনুযায়ী যানবাহন সিএনজিতে রূপান্তরের পর পাঁচ বছর অন্তর একবার সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এটি মনিটরিংয়ের দায়িত্বও বিস্ফোরক পরিদফতরের। কিন্তু মেয়াদ শেষ হলেও যানবাহনগুলোর পুনঃপরীক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই।

সর্বশেষ খবর