রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

নিপুণ খুনেও খুনি ধরা

মির্জা মেহেদী তমাল

নিপুণ খুনেও খুনি ধরা

বগুড়ার শেরপুর। ইউক্যালিপটাস গাছের একটি বড় বাগানের ভিতর দিয়ে পথচারীদের চলার পথ। এক সকালে লোকজন ওই পথেই অন্যান্য দিনের মতো পথ চলছিল। গ্রামবাসীদের চোখ আটকে যায় একটি গাছের দিকে। একজন বৃদ্ধের লাশ উঁচু ডালে ঝুলে আছে। আতঙ্ক চোখে-মুখে সবার। লাশ ঝুলে থাকার খবরটি চাউর হয়ে পড়ে। পুলিশ আসে। গলায় দড়ি বাঁধা ঝুলন্ত বৃদ্ধের লাশ পুলিশ নামিয়ে আনে। ভিড় করে থাকা উৎসুক মানুষকে পুলিশ জিজ্ঞেস করে, কারও পরিচিত কিনা, জানতে চায়। গ্রামের লোকজন বৃদ্ধকে চিনতে পারেনি। সবাই নিশ্চিত করেই বলল, এই বৃদ্ধটি গ্রামের নয়। অন্য কোনো গ্রামের বাসিন্দা। ঘণ্টাখানেক পর এক নারী কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এলেন সেই বাগানে। ততক্ষণে লাশ থানায়। সেই নারী ছুটে যান থানায়। লাশ দেখে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। লাশ ধরে আহাজারি করতে থাকেন। তিনি পুলিশকে নিজের নাম রহিমা বলে জানান। বলেন, এই বৃদ্ধ ব্যক্তিটির ছোট বোন তিনি। নাম ছবের আলী। ছোট বোন রহিমা। লাশের সামনে থেকে কেউ তাকে সরাতে পারছিল না। কান্না করছিলেন আর বলছিলেন, ‘ও আমার ভাইগো, তুমি কই গেলা। আমারেও নিয়া যাওগো।’ এরপর আসে ছবের আলীর স্ত্রী-সন্তানেরা। ছবের আলীর বাড়ি বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ঘোলাগাড়িয়া গ্রামে। ২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি সকালে ছবের আলীর লাশ উদ্ধার হয়। আগের রাতে ছবের আলী নাটোরের সিংড়া উপজেলার লয়দাপাড়া গ্রামে তার ছোট বোন রহিমার বাড়িতে পারিবারিক বৈঠকে এসেছিলেন। ছবের আলী হঠাৎ বাসা থেকে বেরিয়ে যান। রাতে তার আর খোঁজ মেলেনি। সকালে তার লাশ খুঁজে পাওয়া যায়। বিভিন্ন কারণে মানসিক অসুস্থতার কারণে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে ভাইবোন পুলিশকে জানিয়েছেন। কিন্তু ছবের আলীর স্ত্রী এটি বিশ্বাস করেননি। তার ধারণা, এটি পরিকল্পিত হত্যা। কিন্তু থানায় মামলা হয় অপমৃত্যু। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। কিন্তু ছবের আলীর স্ত্রী মর্জিনা ঘটনার ১০ দিন পর আদালতে মামলা করেন। আদালত থেকে মামলাটি তদন্তের জন্য শেরপুর থানায় আসে ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। শেরপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আলহাজউদ্দিন তদন্ত শুরু করেন। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন হাতে পায় পুলিশ। তাতে লেখা রয়েছে, মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা। পুলিশের তদন্ত সেদিকেই যায়। পুলিশ আদালতে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে বলে, ছবের আলী আত্মহত্যা করেছেন। এই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি দেন মর্জিনা। আবারও তদন্তের নির্দেশ আসে আদালত থেকে। ফের প্রতিবেদন দেওয়া হয় আত্মহত্যা। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের বাইরে গিয়ে পুলিশ তদন্ত করে না। যে কারণে আগের প্রতিবেদনই বহাল থাকে। ছবের আলীর স্ত্রী মর্জিনা দমে যাননি। এর পেছনে তিনি রয়ে গেছেন। আবারও আদালতের কাছে আবেদন জানান। আদালত এবার দায়িত্ব দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-কে। পিবিআই নতুন করে তদন্ত শুরু করে। ঘটনার তিন বছর ১০ মাস পর হত্যা রহস্য উদঘাটন হয়। চিহ্নিত হয় খুনি। গ্রেফতার করে তাদের পাঠানো হয় কারাগারে। আর এ ঘটনার তদন্তে পুলিশ যা জানতে পারে, তাতে তারা হতবাক। পিবিআই জানতে পারে, ১৭ বিঘা জমি নিয়ে আপন ভাইবোনের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল ছবের আলীর। সেই রাতে ছবের আলীকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় জমির বিষয়ে বৈঠক করবে বলে। রাতে মর্জিনাকে ফোন করে ছবের আলী জানায়, রাতে বোনের বাসায় থেকে যাবেন। কারণ আলোচনা তাদের শেষ হয়নি। পরে সকালে জানাজানি হয় ছবের আলী আত্মহত্যা করেছেন। ছবের আলীর বোনের ছেলে রবিউল ইসলামকে গ্রেফতার করলে ফাঁস হয় ছবের আলীর মৃত্যুর রহস্য। রবিউল পুলিশকে বলে, পারিবারিকভাবেই সিদ্ধান্ত হয়েছে বড় মামাকে (ছবের আলী) খুন করার। এটা করা হলে সব জায়গা মা ও ছোট মামা মিলে দখল করতে পারবেন। এ কারণে ঘটনার দিন কৌশলে  বৈঠক করার কথা বলে শেরপুর থেকে মামা ছবের আলীকে নাটোরে নিয়ে আসি। এরপর রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর তাকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। খুনটি আমরা এমনভাবে করব বলে পরিকল্পনা নিয়েছি যেন, সবাই বুঝতে পারে এটি আত্মহত্যা। আমরা মামাকে ৭-৮ কিলোমিটার দূরের একটি বাগানে নিয়ে যাই। সেই বাগানের ভিতরে একটি গাছে চড়িয়ে দেই একজনকে। সঙ্গে দড়ির একটি মাথাও দেই। তার দায়িত্ব থাকবে দড়িটা ডালের সঙ্গে পেঁচিয়ে নিচে দিয়ে দেবে। তার আগে আমরা মামার গলায় দড়ি পেঁচিয়ে দেব। গলায় দড়ি দিয়ে একজন আত্মহত্যা যেভাবে করে, ঠিক সেভাবেই আমরা খুনের ঘটনাটি ঘটিয়েছি। হত্যায় আমি, বাবা ছবির উদ্দিন ও ছোট মামা চান মিয়া ও আনছার আলী অংশ নেন। পরে হত্যাকা-কে আত্মহত্যা বলে প্রচার চালিয়েছি। রবিউলের এমন সাবলীল স্বীকারোক্তিতে পিবিআই কর্মকর্তারা হতবাক হয়েছেন। আর এর মধ্য দিয়ে ঘটনার তিন বছরের বেশি সময় পর জানা যায়, ছবের আলী আত্মহত্যা নয়, তাকে খুন করা হয়েছিল। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, খুনে যত কৌশল অবলম্বন করা হোক না কেন, খুনি গ্রেফতার হবেই। খুনের ঘটনা কখনো আড়াল করা যায় না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর