বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভয়ঙ্কর অপরাধে নারী

হত্যা জঙ্গিবাদ সোনা ও মানব পাচার, মাদক ব্যবসা, প্রতারণা, ছিনতাইসহ ১০ অপরাধে জড়িত

জিন্নাতুন নূর

ভয়ঙ্কর অপরাধে নারী

ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যায় দন্ডিত আসামিদের মধ্যে দুজন নারী তার সহপাঠী। এর একজন কামরুন নাহার মণি। আগুনে পুড়িয়ে হত্যার সময় নুসরাতের হাত বাঁধেন এবং তাকে চেপে ধরেন তিনি। হত্যার জন্য নুসরাতকে ক্লাস থেকে ডেকে ছাদে নিয়ে যান এবং ওড়না দিয়ে হাত পেছনে নিয়ে বাঁধেন উম্মে সুলতানা নামে আরেক নারী। মণি ও সুলতানা পেশাদার খুনি নন। কিন্তু নিজ সহপাঠীকে নির্মমভাবে তারা হত্যা করেছেন। নুসরাত হত্যার পরিকল্পনায় অংশ নিয়ে এবং অন্য হত্যাকারীদের সহযোগিতা করে মণি ও সুলতানা দেশজুড়ে সমালোচিত হন।

সম্প্রতি রাজধানীর ধানমন্ডিতে শিল্পপতি মনির উদ্দিনের শাশুড়ি আফরোজা বেগম (৬৫) এবং তাদের গৃহপরিচারিকা দিতিকে (১৯) নির্মমভাবে গলা কেটে হত্যা করেন ওই বাসার নতুন গৃহকর্মী সুরভী আক্তার। পরে পুলিশের হাতে আটক হয়ে স্বীকারোক্তিতে সুরভী জানান, ঘর থেকে বের হতে না দেওয়ায় তিনি এ হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছেন।

শুধু হত্যা নয়, জঙ্গিবাদ, মানব পাচার, স্বর্ণ পাচার, মাদক ব্যবসা, প্রতারণা, শিশু চুরি, ছিনতাই ও অপহরণের মতো বড় বড় অপরাধেও নারীরা সম্পৃক্ত হচ্ছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, নারী কোনো অপরাধে জড়িত থাকতে পারেন সমাজ তা বিশ্বাস করে না। আর অপরাধী সিন্ডিকেট সমাজের এই বিশ্বাসকে কাজে লাগায়। ফলে তারা নারীকে দিয়ে সহজেই নানা ধরনের অপরাধ করাতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জিয়া রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশে নারী অপরাধীদের এক ধরনের ‘ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার পুরুষের মতো কাজের সুযোগ না থাকায় নারীরা বাধ্য হয়ে অপরাধে জড়াচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে সমাজে ইতিবাচক ইমেজ থাকায় নারী অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত হতে পারেন এমনটা কেউ বিশ্বাস করতে চান না। নারীরা বহু আগে থেকে নারী পাচারের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িত। বিশেষ করে পাচারকারী সিন্ডিকেটের সঙ্গে থাকা নারী সদস্যরা ফুসলিয়ে, ভালো কাজের আশ্বাস দিয়ে বিভিন্ন বয়সী নারীদের পাচারের ফাঁদে ফেলেন। সম্প্রতি এমনই এক সংঘবদ্ধ চক্রের নারী সদস্য সাথী বেগম (২৫) ঝালকাঠির কাঁঠালিয়ার দুই স্কুলছাত্রীকে ভারতে পাচারের চেষ্টাকালে গ্রেফতার হন। সাথী তার সহযোগীদের সঙ্গে মিলে ওই দুই ছাত্রীকে ভারতে পাচারের চেষ্টা করেন। আকাশপথে স্বর্ণ পাচারের মতো অপরাধেও নারীরা জড়িত। বিভিন্ন এয়ারলাইনসে কর্মরত বিমানবালা বা কেবিন ক্রুদের দিয়ে কৌশলে স্বর্ণ পাচার করা হয়। সম্প্রতি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক কেবিন ক্রুর শরীর থেকে প্রায় ১০ কেজি স্বর্ণ জব্দ করে বিমানবন্দর এপিবিএন পুলিশ। রোকেয়া শেখ মৌসুমী নামের এই কেবিন ক্রু ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের বিএস৩২২ ফ্লাইটে মাসকট থেকে চট্টগ্রাম হয়ে শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। মৌসুমী তার শরীরে কৌশলে ৬টি প্যাকেটে ৮২টি সোনার বার লুকিয়ে পাচারের চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে মৌসুমী কাস্টম কর্মকর্তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ টার্মিনাল দিয়ে গাড়িতে উঠতে গেলে এপিবিএন পুলিশ তাকে চ্যালেঞ্জ করে। মাদক ব্যবসা ও বহনের মতো বড় অপরাধেও নারী জড়িত। গত বছরের মাঝামাঝি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঢাকার ২৫ মাদকসম্রাজ্ঞীর তালিকা তৈরি করে তাদের ধরতে অভিযান চালায়। এর মধ্যে কয়েকজনকে ওই সময় আটক করা হলেও অনেকেই আত্মগোপনে চলে যান। সম্প্রতি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একটি বিশেষ টিম সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে শীর্ষ মাদকসম্রাজ্ঞী জমিলা খাতুনকে গ্রেফতার করে। জমিলার বিরুদ্ধে আগে থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন থানায় প্রায় দ্ইু ডজন মামলা ছিল। জমিলা কমলাপুর, টিটিপাড়া, মুগদা ও শাহজাহানপুরে তিন দশক ধরে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, পরিবারের সদস্যদের সাহচর্যে নারীরা জঙ্গিবাদেও জড়িয়ে পড়ছেন। নারী জঙ্গিদের কেউ কেউ আত্মঘাতীও হয়েছেন। মূলত নারী বলে সন্দেহ কম হবে- এ ধারণা থেকে তাদের জঙ্গিবাদে জড়ানোর হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই নারীদের বেশির ভাগই স্বামীর হাত ধরে জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছেন। কেউ আবার ভার্চুয়াল মিডিয়ায় প্রভাবিত হয়েও জড়াচ্ছেন জঙ্গিবাদে। সরকারি হাসপাতালগুলোয় নবজাতক চুরির ঘটনা প্রায়ই ঘটে। আর এ কাজে বেশির ভাগ সময়ই হাসপাতালে কর্মরত পার্টটাইম আয়ারা জড়িত থাকেন। মূলত এই আয়ারা নবজাতক চুরির সিন্ডিকেটের একজন সদস্য। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে অবস্থাপন্ন যুবকদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে অনেক নারী প্রতারণার ফাঁদে ফেলে তাদের সর্বস্ব লুটে নিচ্ছেন। ফেসবুকে অল্প কয়েক দিনের পরিচয়েও কিছু নারী ‘বিপদে পড়েছেন, এজন্য জরুরি অর্থ প্রয়োজন’ এমনটি বলে অনেক ছেলের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। আবার পুরুষ অপহরণকারীদের সঙ্গে এখন অপহরণের মতো অপরাধেও জড়াচ্ছেন নারীরা। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে অপহরণকারীরা নারীকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। বিত্তশালী পুুরুষদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে অপহরণ ছাড়াও শিশুদেরও অপহরণ করতে অপরাধী সিন্ডিকেট নারীদের ব্যবহার করছে। এর বাইরে ছিনতাইয়ের মতো অপরাধেও এখন নারীদের সম্পৃক্ততা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর