শিরোনাম
রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ধর্মঘটে অচল নৌপথ

রাতে প্রত্যাহার, দিনভর বন্দর থেকে পণ্য পরিবহন বন্ধ, রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত, সিমেন্ট এলপি গ্যাসসহ মোংলা শিল্পাঞ্চলে উৎপাদিত পণ্য পাঠানো বন্ধ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ধর্মঘটে অচল নৌপথ

নৌ ধর্মঘটে গতকাল রাজধানীর সদরঘাটের চিত্র -বাংলাদেশ প্রতিদিন

দিনভর অচল হয়ে পড়া সারা দেশের নৌ ধর্মঘট গতরাতে প্রত্যাহার করা হয়েছে। শ্রমিকদের নিয়োগপত্র ও খাবার ভাতা দেওয়াসহ ১১ দফা দাবিতে নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের ডাকে শুক্রবার রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে শুরু হয় ধর্মঘট। এতে দক্ষিণ জনপদের জেলাগুলো থেকে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যাত্রীদের ব্যাপক ভোগান্তি হয়। মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য ওঠা-নামা ব্যাহত হয়। এই প্রেক্ষাপটে শ্রম অধিদফতরের মহাপরিচালক এ কে এম মিজানুর রহমান গতকাল বিকাল ৩টা থেকে শ্রম ভবনে লঞ্চ মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। সেখানে নীতিগতভাবে শ্রমিকদের সব দাবি মেনে নেওয়ায় ফেডারেশনের নেতারা ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন বলে শ্রম মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা আখতার হোসেন জানান। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সরকার শ্রমিকদের দাবি সব মেনে নিয়েছে। তাদের খাদ্য ভাতা ২০২০ সালের মার্চ থেকে কার্যকর করা হবে।’

এর আগে দিনভর নৌ ধর্মঘটে নৌপথের যাত্রী ও পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দরসহ দেশের নদীবন্দরগুলো থেকে যাত্রী পরিবহন ও পণ্য ওঠা-নামা বন্ধ থাকায় নৌপথের যাত্রীরা দুর্ভোগে পড়েন। ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য। অন্যদিকে মোংলা শিল্পাঞ্চল ও ইপিজেডের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত সিমেন্ট, এলপিজি গ্যাসসহ বিভিন্ন পণ্য নৌপথে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো বন্ধ যায়। দিনভর পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকায় বাজারে দ্রব্যমূল্যে প্রভাব পড়তে শুরু করে।

বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের ১১ দফা দাবির ধর্মঘটে স্থবির হয়ে যায় পুরান ঢাকার সদরঘাট এলাকার লঞ্চ চলাচল। গতকাল রাত সোয়া ১১টার দিকে নৌ ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়। এর আগে শুক্রবার মধ্যরাত থেকে অনির্দিষ্টকালের এ ধর্মঘটে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের পাশাপাশি চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও ঝালকাঠিসহ ৩৩ নৌপথে নৌযান চলাচল বন্ধ ছিল। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা। দক্ষিণাঞ্চলের পণ্যবাহী ট্রলার শ্যামবাজারে না আসায় কাঁচা তরকারির দাম বেড়ে যায়।

শ্রমিক ফেডারেশনের ১১ দফা দাবি ছিল- ১. বাল্কহেডসহ সব নৌযান ও নৌপথে চাঁদাবাজি, ডাকাতি বন্ধ করা। ২. ২০১৬ সালে ঘোষিত গেজেট অনুযায়ী নৌযানের সর্বস্তরের শ্রমিকদের বেতন প্রদান। ৩. ভারতগামী শ্রমিকদের ল্যান্ডিং পাস এবং মালিক কর্তৃক খাদ্যভাতা প্রদান। ৪. সব নৌযান শ্রমিকের সমুদ্র ও রাত্রিকালীন ভাতা নির্ধারণ। ৫. এনড্রোস, ইনচার্জ, টেকনিক্যাল ভাতা পুনর্নির্ধারণ। ৬. কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ ১০ লাখ টাকা নির্ধারণ। ৭. প্রত্যেক নৌ-শ্রমিককে মালিক কর্তৃক নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র ও সার্ভিস বুক প্রদান। ৮. নদীর নাব্য রক্ষা ও প্রয়োজনীয় মার্কা, বয়া ও বাতি স্থাপন। ৯. মাস্টার/ড্রাইভার পরীক্ষা, সনদ বিতরণ ও সনদ নবায়ন, বেআইনি নৌচলাচল বন্ধ করা। ১০. নৌপরিবহন অধিদফতরে সব ধরনের অনিয়ম ও শ্রমিক হয়রানি বন্ধ এবং ১১. নৌযান শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

নৌযান শ্রমিক ধর্মঘটে সদরঘাটে এসে বিপাকে পড়েন যাত্রীরা। নিয়মিত রুটের লঞ্চ চলাচল না করলেও বিকল্প ব্যবস্থায় সীমিত সংখ্যক লঞ্চ চলাচল করে। অনেক যাত্রী কাক্সিক্ষত লঞ্চ না পেয়ে ফিরে গেছেন। চাঁদপুর ঘাটে চাঁদপুরের শিডিউলের লঞ্চ দেখা যায়নি। সুরেশ্বর, শৌলা, মুলাদী, দুলারচর লঞ্চ চলাচল বন্ধ ছিল। বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও ঝালকাঠিসহ অন্যান্য লঞ্চ সদরঘাটে নোঙ্গর করা। এ ছাড়া পণ্যবাহী নৌযান বন্ধ থাকায় সদরঘাটের পাশে পাইকারি বাজারে পণ্যের দাম বেড়েছে।

বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের অফিস সচিব রাকিব হাসান শাওন বলেন, নৌযান মালিক ও সরকার বারবার আমাদের দাবিগুলো যৌক্তিক বলে মেনে নেন, কিন্তু বাস্তবায়ন করেন না। গত জুলাইয়ে আমরা আন্দোলন শুরু করার পর সরকার ও মালিকদের পক্ষ থেকে আমাদের বলা হলো, দাবি মানা হবে। কিন্তু তারা ওয়াদা ভঙ্গ করেছে, তাই ধর্মঘটে বাধ্য হয়েছি। এবার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) যুগ্ম পরিচালক আলমগীর কবীর বলেন, নৌযান শ্রমিকদের মূল দাবি তাদের মালিকদের সঙ্গে, আমাদের কাছে যেসব দাবি উপস্থাপন করা হয়েছে তা বাস্তবায়নাধীন। এই সময়ে তাদের এই ধর্মঘট উদ্দেশ্যমূলক। সরকার তাদের দাবি পূরণে তিন মাস সময় দিয়েছে, তা মালিকরা পূরণ করার কথা।

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম জানান, নৌযান শ্রমিক ধর্মঘটে অচল চট্টগ্রাম থেকে নৌপথে পণ্য পরিবহন ও বন্দরের বহির্নোঙ্গরে পণ্য খালাস কার্যক্রম। বহির্নোঙ্গরে অলস বসে আছে বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য নিয়ে আসা ৭৮টি মাদার ভ্যাসেল। কর্ণফুলী নদীতে অলস বসে আছে এক হাজারেরও বেশি লাইটারেজ জাহাজ। এতে বড় ধরনের ব্যবসায়িক ক্ষতির আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, বন্দরের ভিতরে জেটিতে স্বাভাবিক কাজ হচ্ছে। ইয়ার্ড থেকে কনটেইনার খালাস হচ্ছে। জাহাজে কনটেইনার ওঠানামা স্বাভাবিক আছে। তবে আউটারে কাজ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে পণ্যবাহী বড় জাহাজ আছে ৭৮টি। এর মধ্যে ৪৯টি জাহাজ পণ্য খালাসের অপেক্ষায় আছে। বাকি ২৯টি জাহাজ পণ্য খালাসের শিডিউল নেওয়ার অপেক্ষায় আছে। কিন্তু গতকাল সকাল থেকে কোনো লাইটারেজ জাহাজই বহির্নোঙ্গরে যায়নি। এমনকি আগে থেকে পণ্য খালাসে নিয়োজিত থাকা জাহাজগুলোও খালাস শেষ না করেই ঘাটে ফিরে এসেছে।

বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, মোংলায় অনির্দিষ্টকালের নৌযান ধর্মঘটে গতকাল ভোর থেকে কার্গো, লাইটার জাহাজসহ শত শত নৌযান মোংলা নদী ও বন্দরের পশুর চ্যানেলে নোঙ্গর করে রয়েছে। সকালের পালা থেকে মোংলা বন্দরের আউটার অ্যাংকরেজে অবস্থানরত মাদার ভ্যাসেলসহ ২৩টি জাহাজ থেকে লাইটার জাহাজে পণ্য খালাস কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় অচল হয়ে পড়েছে মোংলা সমুদ্রবন্দর। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার মাস্টার মো. ফকর উদ্দিন জানান, বন্দরের আউটার অ্যাংকরেজে ২৩টি জাহাজে পণ্য ওঠানামার কাজ ধর্মঘটের কারণে বন্ধ হয়ে গেলেও বন্দর জেটিতে অবস্থানরত ৪টি জাহাজে পণ্য ওঠানামার কাজ চলছে। মোংলা শিল্পাঞ্চল ও ইপিজেড এলাকার শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘটের প্রথম দিনেই প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সিমেন্ট, এলপিজি গ্যাসসহ মোংলা শিল্পাঞ্চল ও ইপিজেডের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্য নৌপথে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো বন্ধ হয়ে গেছে।

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল জানান, বরিশাল থেকে যাত্রী, পণ্য ও জ্বালানিবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। চরম দুর্ভোগে পড়েছেন নৌপথের যাত্রীরা। পণ্য ও জ্বালানি পরিবহন বন্ধ থাকায় নিত্যপণ্যের দাম আরেক ধাপ বাড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের তৃতীয় বৃহত্তম বরিশাল নদীবন্দর থেকে প্রতিদিন স্থানীয় ও দূরপাল্লা রুটের শতাধিক নৌযান ছেড়ে যায়। হাজারো যাত্রী এবং নৌযান শ্রমিকের পদভারে মুখরিত থাকে বরিশাল নদীবন্দর। কিন্তু গতকাল নদীবন্দরে ছিল সুনসান নীরবতা। সকাল ১০টার পরপরই যাত্রীবাহী নৌযান ও পণ্যবাহী জাহাজগুলো নদীবন্দর থেকে সরিয়ে মাঝ নদীতে নোঙ্গর করে রাখা হয়।

চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, ধর্মঘটে চাঁদপুর নৌবন্দর থেকে গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত কোনো লঞ্চ ছেড়ে যায়নি। দুপুর ১২টার পরে ৩টি লঞ্চ ঢাকা ও মুলাদীর উদ্দেশে ছেড়ে যায়। চাঁদপুর বন্দর পরিদর্শক শাহ আলম জানান, শিডিউলের টাইম ছাড়াই দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে চাঁদপুর ঘাট থেকে এমভি শরীয়তপুর-১ মুলাদীর উদ্দেশে ছেড়ে যায়। দুপুর ১টায় মিরাজ-২ এবং বিকাল ৩টা ৪০ মিনিটে এমভি সোনারতরী-২ চাঁদপুর ঘাট থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে গেছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি জানান, আশুগঞ্জ বন্দরে নৌযান এবং পণ্য ওঠানামা বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক হাবিবুল্লাহ বাহার জানান, নৌপথে চাঁদাবাজি ও ডাকাতি বন্ধ, নিরাপত্তা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দাবিতে ধর্মঘট ডাকা হয়েছে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে।

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ধর্মঘটে অচল হয়ে পড়েছে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী নৌবন্দর। কর্মবিরতির কারণে বন্দরে সব কার্গো জাহাজ, লাইটার জাহাজ ও বলগেট চলাচল বন্ধ ছিল। কোনো মালামাল আনলোড হয়নি। পটুয়াখালী প্রতিনিধি জানান, গতকাল সকাল থেকে পটুয়াখালী নদীবন্দর থেকে কোনো লঞ্চ ছেড়ে যায়নি।

আমতলী (বরগুনা) প্রতিনিধি জানান, আমতলী লঞ্চঘাট থেকে কোনো লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়নি। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন আমতলী-তালতলী-কলাপাড়া উপজেলা ও পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার যাত্রীরা। নিরুপায় হয়ে যাত্রীরা সড়কপথে পরিবহনে ঢাকা যাচ্ছেন। অনেক যাত্রী ঢাকায় না গিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর