শিরোনাম
রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

পাহাড়ে চুক্তিতে ফেরেনি স্বস্তি

২২ বছরেও মেটেনি সংঘাত

ফাতেমা জান্নাত মুমু, রাঙামাটি

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ২২ বছর। কিন্তু তবু মেটেনি সংঘাত। এ চুক্তিতে ফেরেনি স্বস্তি। অথচ এ চুক্তির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল শান্তি ও সম্প্রীতি। কিন্তু দীর্ঘ ২২ বছরেও শান্তির সুবাতাসের লেশমাত্র দেখেননি পাহাড়ের বাসিন্দারা। উল্টো প্রতিযোগিতা আর নানা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করছেন পার্বত্যাঞ্চলের মানুষ। সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানিতে কালো মেঘের ছায়ায় ঢেকে আছে সবুজ পাহাড়। তবু নিরাপত্তাহীনতার ভয়ে মুখ খুলছে না কেউ। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এখানে দ্বন্দ্বের সীমা নেই। ২২ বছরে দূরত্ব বেড়েছে বিশ্বাস-আস্থার। জন্ম নিয়েছে নতুন নতুন নামে সশস্ত্র আঞ্চলিক সংগঠন। তাদের ক্ষমতার দাপটে চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, আধিপত্য বিস্তার ও জাতিগত ভেদাভেদ এসব কারণে প্রায় প্রতিনিয়ত অশান্ত থাকে পাহাড়। ঘটে রক্তক্ষয়ী সংঘাত। প্রাণ হারায় নিরীহ মানুষ। সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ক্ষমতা কতটা ভয়াবহ তা পাহাড়ের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায়। তাদের বন্দুকের গুলিতে প্রায়ই রক্তবর্ণ হয় পাহাড়। এমন কর্মকান্ডের চিত্র প্রায় দিনই খবরের কাগজের শিরোনাম হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘাত অবসানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদের তৎকালীন চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। ওই চুক্তির সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও উপস্থিত ছিলেন। ওই চুক্তির মধ্য দিয়ে তৎকালীন সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ শান্তিবাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র সমর্পণ করেন। এর মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে দুই দশকের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ সমাপ্ত হয়। সে সময়কার শান্তির সুবাতাস এখন শুধুই স্বপ্ন। বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। এখন পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। গত ২৩ মাসে পার্বত্যাঞ্চলে ৭২টি হত্যাকা- ঘটেছে। এগুলোর বেশির ভাগই ঘটেছে চাঁদাবাজি ও দলীয় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে। শুধু তা-ই নয়, দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা পাননি পুলিশ, সেনাসদস্যসহ স্থানীয় বাসিন্দারা। তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতারা বলছেন, পার্বত্য চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন না হলে এসব সমস্যা কোনো দিন সমাধান হবে না। এ ব্যাপারে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমা বলেছেন, ‘পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হলে এ অঞ্চলের সমস্যা সমাধান হবে না। তাই পার্বত্য চুক্তি যাতে বাস্তবায়িত হতে পারে তার জন্য সরকার, ব্যক্তিবিশেষ, সংগঠনকে আরও আন্তরিক হতে হবে। পার্বত্যাঞ্চলের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যেই তো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। আজকে ২২ বছর অতিবাহিত হয়ে গেল কিন্তু চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। সুতরাং যত দিন এ মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন হবে না, তত দিন পর্যন্ত পার্বত্যাঞ্চলের সমস্যার সমাধান হয়েছে বলে আমরা দাবি রাখতে পারি না।’ অন্যদিকে সরকারদলীয় নেতারা বলছেন, চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে এখন পর্যন্ত ৪৮টি বাস্তবায়িত হয়েছে। ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। ৯টি ধারা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ ব্যাপারে রাঙামাটি জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও তিন পার্বত্য সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনু বলেছেন, ‘শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন বাকি আছে বলে আমি মনে করি না। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ইচ্ছা অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করা হয়েছে। তারা যেভাবে চেয়েছে সেভাবে হয়েছে। তাদের মতো কমিশন কাজ করছে। এর পরও যদি তারা বলে শান্তিচুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি, তা তাদের ব্যর্থতা।’ পার্বত্য চট্টগ্রাম বাঙালি ছাত্র পরিষদের সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন শান্তিবাহিনীর সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর এ শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করে পাহাড়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ১৯৯৮ সালে গড়ে ওঠে আরেকটি আঞ্চলিক দল, যার নাম ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। আবার এ দুটি দলের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা ও অগণতান্ত্রিক আচরণের অভিযোগ তুলে পাহাড়ে জন্ম নিয়েছে গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ এবং জেএসএস সংস্কার (এম এন লারমা) নামের আরও দুটি আঞ্চলিক দল। তাদের মধ্যে বিরোধ এখন চরমে। তাই পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে চুক্তি বাস্তবায়নের আগে সব ধরনের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। যত দিন পাহাড়ে অস্ত্রের ঝনঝনানি থাকবে তত দিন এখানে শান্তি ফিরে আসবে না।

সর্বশেষ খবর