শিরোনাম
সোমবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

আটকে গেছে খানজাহান আলী বিমানবন্দর

২৩ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি প্রকল্প, সবকিছু শুধুই পরিকল্পনাতে

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

আটকে গেছে খানজাহান আলী বিমানবন্দর

খানজাহান আলী বিমানবন্দরের সাইনবোর্ড -বাংলাদেশ প্রতিদিন

সরকারের নেওয়া একটি প্রকল্প গত ২৩ বছর ধরে ঝুলে আছে, যা নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিলেন। এটি হলো বাগেরহাট খানজাহান আলী বিমানবন্দর নির্মাণ প্রকল্প। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য এই স্বপ্নের প্রকল্পটি নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। দুই দশকের বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর এখন খোদ প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান অভিযোগ করছেন, ‘প্রকল্পটির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর যে নির্দেশনা ছিল তা সঠিকভাবে অনুসরণ ও বাস্তবায়ন হয়নি।’ অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে এ কথা এখন নিশ্চিত করেই বলা যাচ্ছে যে, ওই প্রকল্পটি এখনো কাগজে-কলমে আর পরিকল্পনায়ই আটকে আছে। প্রকল্পটি কোন প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন হবে তা নিয়েও রয়েছ যথেষ্ট অনিশ্চয়তা। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বিকল্প অর্থায়নের বিষয়ে গত ১৬ অক্টোবর একটি সভা হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় দক্ষিণাঞ্চলের এই স্বপ্নের প্রকল্পটি নিয়ে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, ওই সভায় পিপিপি কর্তৃপক্ষ জানায়, খানজাহান আলী বিমানবন্দর নির্মাণ প্রকল্প বিষয়ে একটি সমীক্ষা করেছে প্রাইস ওয়াটার হাউস। তাদের সমীক্ষা প্রতিবেদন পর্যালোচনাধীন রয়েছে। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হতাশা প্রকাশ করে বলেন, পূর্ণাঙ্গ প্রকল্প প্রস্তাব হয়তো এখনো প্রস্তুত হয়নি। ড. মসিউর এই আঞ্চলিক বিমানবন্দরের নির্মাণের যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলেন, রামপালে অর্থনৈতিক অঞ্চল, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল ও এলপিজি হাব গড়ে তোলা হচ্ছে। মোংলা সমুদ্রবন্দরকে কার্যকর করতে চাইলে বিমানবন্দরটি পণ্য পরিবহনের কাজেও ব্যবহার করা যাবে। জবাবে পিপিপি কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রস্তাবিত বিমানবন্দরের বিস্তারিত সমীক্ষায় পণ্য পরিবহনের বিষয়টি নেই। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রাইস ওয়াটার হাউস একটি অসম্পূর্ণ প্রকল্প সম্পর্কে মতামত দিয়েছে। এটিকে তিনি ‘অযাচিত প্রস্তাবনা’ বলেও অভিহিত করেন। মন্ত্রণালয় সংকীর্ণ দৃষ্টিতে ‘বিমানবন্দর’ কল্পনা করছে-এমন মন্তব্য করে ড. মসিউর বলেন, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ সঠিকভাবে অনুসরণ ও বাস্তবায়ন হয়নি। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মিজানুর রহমান ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল সন্ধ্যায় টেলিফোনে তিনি বলেন, আমি সভায় উপস্থিত ছিলাম কিন্তু এই প্রকল্পটি আমার ডেস্কের নয়। এটি অন্য একজন অতিরিক্ত সচিব দেখছেন। প্রস্তাবিত প্রকল্পের ওপর একটি সমীক্ষা হয়েছে এবং ভূমি অধিগ্রহণ ও দেয়াল নির্মাণের কাজ চলছে আমি এটুকুই আপনাকে বলতে পারি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন, পর্যটন ও পরিকল্পনা) মো. আতিকুল হক বলেন, ‘খানজাহান আলী বিমানবন্দর’-এর বিষয়ে আমরা যে সমীক্ষা রিপোর্ট পেয়েছি, তা দিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না। কনসালটেন্ট ফার্ম প্রাইস ওয়াটার হাউস সমীক্ষার কোথাও প্রকল্পটি লাভজনক আবার কোথাও কোথাও ‘লাভজনক নয়’ বলে উল্লেখ করেছে। বিশেষ করে এই প্রকল্পটি পিপিপি (সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব) ভিত্তিতে লাভজনক হবে না বলে সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে এটি পিপিপি ভিত্তিতে নির্মাণের সম্ভাবনা খুব কম। পিপিপি-তে না হলে এটি সরকারি অর্থায়নে হবে। কারণ সরকারের কাজ লাভ করা নয়, জনগণের স্বার্থ দেখা। এখন এই প্রকল্পটির বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে যে সিদ্ধান্ত আসবে সেভাবেই হবে। ২০১৫ সালের ৫ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ‘খানজাহান আলী বিমানবন্দর নির্মাণ’ প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়েছিল। একনেক সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী জানিয়েছিলেন, প্রকল্পটি সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়ন হবে। নির্মাণ ব্যয় ৫৪৪ কোটি টাকার মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৪৯০ কোটি টাকা দেওয়া হবে। বাকি ৫৪ কোটি টাকা দেবে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিল থেকে।  এর ২ বছর পর ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাগেরহাটের রামপালে নির্মিতব্য খানজাহান আলী বিমানবন্দর একনেকের সিদ্ধান্ত পাল্টে দিয়ে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) আওতায় করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় এটি অনুমোদন দেওয়া হয়। সভার পরে ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তখনকার অতিরিক্ত সচিব  মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, খানজাহান আলী বিমানবন্দর নির্মাণ প্রকল্প পিপিপির আওতায় বাস্তবায়নের প্রস্তাবে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা কমিটি। সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৫ সালে একনেকে সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পটি অনুমোদন, ২০১৭ সালে পিপিপি ভিত্তিতে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত এবং ২০১৯ সালে এসে পিপিপি থেকে ফিরে গিয়ে আবার সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। গত চার বছর ধরে এভাবে কেবল পরিকল্পনা আর কাগজে-কলমেই আটকে গেছে দক্ষিণের মানুষের স্বপ্নের এই প্রকল্পটি।  কিন্তু একটি প্রকল্প নিয়ে দক্ষিণের মানুষের এই অপেক্ষা কি কেবল এই চার বছরের? এর উত্তর হচ্ছে ‘না’। রাজধানী ঢাকায় একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে কর্মরত খুলনার অধিবাসী জাহাঙ্গীর আলম হতাশা প্রকাশ করে বলেন, সেই ছোটবেলা থেকেই তো শুনে আসছি বিমানবন্দরের কথা। ১৯৯৬ সাল থেকেই তো প্রকল্পটি হচ্ছে আর হচ্ছে বলে কেবল প্রতিশ্রুতিই শুনে আসছি, বাস্তবে একটা সাইনবোর্ড...।

সর্বশেষ খবর