বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
রাবিতে আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা

ভিপি মহিউদ্দীন ১৭ বছরেও ক্ষতিপূরণ পাননি

রুহুল আমিন রাসেল

ভিপি মহিউদ্দীন ১৭ বছরেও ক্ষতিপূরণ পাননি

উচ্চ আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে নজিরবিহীন স্বেচ্ছাচারিতা দেখিয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) প্রশাসন। ফলে বিগত ১৭ বছরেও আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক ক্ষতিপূরণ পাননি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে শয্যাশায়ী বীর মুক্তিযোদ্ধা মুন্সী মহিউদ্দীন আহমেদ মাহিন। এর আগে  তাকে আরও ১৭ বছর আইনি লড়াই করে এলএলবি সনদ পেতে হয়েছে। এভাবেই দীর্ঘ ৩৪ বছর সনদ ও ক্ষতিপূরণ পাওয়ার লড়াই করছেন যশোর এম এম কলেজের সাবেক এই ভিপি। এতেই  মেধাবী এই ছাত্রনেতার জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। এ প্রসঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. এম এ বারী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মাহিনের বিষয়টি আমি জানি না।’ তবে মাহিনের ছেলে আসিফ শাহরিয়ার আহমেদ বলেন, ‘বাবার হাত ধরে যুদ্ধজয়ী একাত্তরের সেই টগবগে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা আজ বয়সের ভারে ন্যুব্জ। তবু তিনি আশাবাদী এবং লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ক্ষতিপূরণ ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। একই সঙ্গে বাবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি আমিও। রাবি কর্তৃপক্ষ বাবার এলএলবি সনদ দিলেও প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ এখনো দেয়নি। অথচ আদালত ক্ষতিপূরণ দিতে বলেছে। যেহেতু আমার বাবা শারীরিকভাবে অসুস্থ, তার পক্ষে আর ক্ষতিপূরণের পেছনে দৌড়ানো সম্ভব নয়, তাই আমি হাল ধরেছি।’

জানা গেছে, মুন্সী মহিউদ্দীন আহমেদ মাহিন ১৯৮৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত যশোরের শহীদ মশিউর রহমান কলেজ থেকে এলএলবি ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৮৮ সালের ৬ এপ্রিল ফল প্রকাশিত হলেও উত্তীর্ণের তালিকায় তার নাম ছিল না। পরে তিনি নম্বরপত্রে দেখতে পান, একটি বিষয়ে পাস নম্বরের চেয়ে ১ নম্বর কম পেয়েছেন। এরপর তিনি উত্তরপত্র পুনর্নিরীক্ষার আবেদন করেন। কিন্তু বেশ কিছুদিন চলে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আর পুনর্নিরীক্ষার ফল প্রকাশ করেনি।

ফলে ওই বছরের শেষ দিকে তিনি যশোরের সহকারী জজ আদালতে দেওয়ানি মামলা করেন। এরপর ১৯৯০ সালে পুনর্নিরীক্ষার ফল প্রকাশের নির্দেশনা দিয়ে রায় দেয় আদালত। তবে সেই রায়ের ব্যাপারে ১৯৯১ সালে যশোরের জেলা জজ আদালতে আপিল করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ১৯৯৩ সালে সেই আপিল খারিজ করে দেয় আদালত। পরে সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগে যায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে ১৯৯৯ সালে সর্বোচ্চ আদালতও আপিলটি খারিজ করে দেয়। একই সঙ্গে পুনর্নিরীক্ষার আবেদনের ফল প্রকাশ করার নির্দেশনার পাশাপাশি আবেদনকারী মামলার খরচপ্রাপ্তির অধিকারী বলেও ঘোষণা দেয় আদালত। তবে এরপর আর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে যায়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ২০০১ সালের ২৯ মার্চ পুনর্নিরীক্ষার ফল প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়। তাতে মুন্সী মহিউদ্দীন আহমেদ মাহিন তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তখন তিনি মামলার খরচ বাবদ ১০ লাখ টাকা দাবি করেছিলেন। বর্তমান হিসাবে ক্ষতিপূরণের অঙ্ক আরও কয়েক গুণ বেড়েছে। ২০০২ সালের ২২ জুন এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আইনি নোটিস পাঠান তিনি। জানা গেছে, মুন্সী মহিউদ্দীন আহমেদ মাহিন ২০০১ সালে পরীক্ষার ফল পাওয়ার পর আইনজীবী হিসেবে কিছুদিন কাজ শুরু করলেও তা তেমনভাবে এগোয়নি। মূলত পুনর্নিরীক্ষার ফল প্রকাশের মামলার পেছনেই চলে গেছে তার ১৭ বছর। আর পরের ১৭ বছর তিনি মামলার খরচ এবং বর্তমানে ক্ষতিপূরণের টাকার পেছনে ছুটছেন। তার স্বপ্ন ছিল আইনজীবী হবেন। কিন্তু ফল নিয়ে মামলা লড়তে গিয়ে তার আর কিছুই করা হয়নি। ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন তিনি। মাহিন বর্তমানে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে শয্যাশায়ী। কয়েক বছর ধরে তিনি বিছানায়ই দিন কাটাচ্ছেন। তবে এখনো হাল ছাড়েননি। তার ছেলে আসিফ বাবার হয়ে ক্ষতিপূরণের জন্য ছুটছেন। সম্প্রতি এ ব্যাপারে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে একাধিক চিঠিও দিয়েছেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে কোনো সদুত্তর পাননি। অবশেষে বাধ্য হয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে চিঠি দিয়েছেন আসিফ।

আসিফ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এক আজন্ম যোদ্ধা আমার বাবার জন্মই হয়তো প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। মৃত্যুর তোয়াক্কা না করে একাত্তরে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলেন বর্বর পাকিস্তানিদের হাত থেকে। দেশ স্বাধীনের পর যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছেন নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। আইনি লড়াই চালিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে। তার ছাত্রত্ব পুনরুদ্ধার এবং এলএলবি পরীক্ষায় ফেল করানো নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। দুটি নিম্ন আদালতে জয়ের পর দ্বারস্থ হতে হয়েছিল উচ্চ আদালতে। প্রতিটি মামলায় রাবি প্রশাসন হেরে গিয়ে আপিলের পর আপিল করেছে। অবশেষে আদালত বাবার পক্ষে রায় দেয় এবং একই সঙ্গে তার ছাত্রত্ব পুনরুদ্ধার, পরীক্ষায় পাস করানো এবং ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য রাবি কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর