বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

যৌন হয়রানি ও হিংস্র আচরণের শিকার ৮০ শতাংশ

জিন্নাতুন নূর

যৌন হয়রানি ও হিংস্র আচরণের শিকার  ৮০ শতাংশ

দেশের রপ্তানি আয়ে অবদান রাখা পোশাক খাতে কর্মরত লাখ লাখ নারী শ্রমিকের সমস্যার শেষ নেই। কাজ করতে গিয়ে প্রতিনিয়তই তাদের নানান সমস্যা মুখ বুজে সহ্য করতে হচ্ছে। বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন এইডের তথ্য বলছে, দেশের পোশাক খাতে কর্মরত নারীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও সহিংস আচরণের শিকার হচ্ছেন। অনেক নারী শ্রমিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, তারা মাতৃত্বকালীন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারেন না। আর কারখানায় দীর্ঘক্ষণ কঠোর পরিশ্রম করার জন্য তারা মাথাব্যথা, চোখে ব্যথা, কাঁধে ব্যথা, পিঠ ও কোমরে ব্যথাসহ ওজন হ্রাসের মতো সমস্যায় ভোগেন। ভালোভাবে বসার ব্যবস্থা না থাকায় তাদের প্রায়ই অস্বস্তি নিয়ে কারখানায় কাজ করতে হয়।

পোশাক খাতের কর্মরত নারী শ্রমিকদের এ ধরনের হয়রানি ও সমস্যার কথা অস্বীকার করেননি বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষও। শ্রমিক নেতারা জানান, নিজের সুস্থতার চেয়েও বড় সমস্যা, তাদের কারখানায় আসা-যাওয়ার পথে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার ভয়ে নিরাপত্তা নিয়েই বেশি উদ্বিগ্ন থাকতে হয়। ন্যাশনাল গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের তথ্যানুযায়ী, একটি কারখানার প্রোডাকশন ম্যানেজার ও ফ্লোর ইনচার্জ সবাই পুরুষ। অন্যদিকে সুইং মেশিন অপারেটর এবং হেলপারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই নারী শ্রমিক। নারী শ্রমিকদের অভিযোগ, সুপারভাইজাররা পুরুষ হওয়ায় তাদের কাছে তারা নিজেদের শারীরিক অসুস্থতার কথা স্বাচ্ছন্দ্যে বলতে পারেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী শ্রমিক জানান, মাসিক চলাকালীন সময় শ্রমিকদের মধ্যে কারও কারও ঘন ঘন টয়লেটে যেতে হয়, কিন্তু এ ধরনের সমস্যার কথা তারা পুরুষ সহকর্মীদের কাছে বলতে পারেন না। তিনি আরও জানান, তাকে দৈনিক ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজ করতে হয় একটি ছোট কাঠের টুলে বসে, যেখানে হেলান দিয়ে বসার কোনো ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া একই নারী শ্রমিককে প্রতি ঘণ্টায় ১০০ শার্টের কাফ তৈরি করতে হয়। আর এই কাজটি করতে গিয়ে নারী শ্রমিকের আঙ্গুল ও হাতের কব্জিতে অনেক চাপ পড়ে। বসার ব্যবস্থার জন্য পিঠে ব্যথা হয়। আবার কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের ধুলাবালি থেকে বাঁচার জন্য মুখে পরার মাস্ক দিলেও গরম অনুভূত হওয়ায় সেই শ্রমিক বেশি সময় ধরে এটি পরে থাকতে পারেন না। তারা আরও জানান, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সন্তান জন্মদানের পর তাদের চাকরি হারাতে হয়। কিছু কারখানা মালিক সন্তান জন্মদানের পরও নারী শ্রমিকদের কারখানায় কাজের সুযোগ দেন, কিন্তু সেক্ষেত্রে তাদের আগের চেয়ে পরিমাণে বেশি কাজ করতে হয়। আবার দুঃখজনক হলেও কিছু কারখানায় গর্ভবতী শ্রমিকদের গর্ভকালীন শেষ সময়ে অতিরিক্ত কাজ করানো হয়, যা সরাসরি ভুক্তিভোগী সেই শ্রমিক ও তার গর্ভের সন্তানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আর ওভারটাইম করতে গিয়ে নারী শ্রমিকরা অবসাদ, গায়ে চুলকানি, মাথা ব্যথাসহ চোখের সমস্যায় ভোগেন। নারী শ্রমিক যারা এখন কাজ করছেন তাদের অনেকেরই পরিকল্পনা- সব মিলিয়ে তারা বড়জোর ১০ বছর গার্মেন্ট কারখানায় কাজ করবেন। এ সময় তারা যে টাকা জমাবেন তা দিয়ে নিজেদের গ্রামের বাড়ি ফিরে গিয়ে একখ- জমি কিনে তাতে বাড়ি বানাবেন। কেউ আবার গ্রামে কাপড় সেলাইয়ের দোকান দেবেন। এর কারণ হিসেবে শ্রমিকরা জানান, কারখানায় দীর্ঘ সময় অমানুষিক পরিশ্রম করার কারণে তারা কর্মশক্তি হারিয়ে ফেলবেন- এ জন্য অনেকেরই আশঙ্কা, ১০ বছর পর হয়তো তারা আর গার্মেন্টে কাজ করতে পারবেন না। পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আবদুুস সালাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নারী শ্রমিকদের যৌন হয়রানির শিকার হতে হয় এ কথা ঠিক, তবে এ ধরনের ঘটনা কমাতে কয়েকটি এনজিওর সঙ্গে মিলে আমরা কাজ করছি। এতে আগের তুলনায় যৌন হয়রানির ঘটনা অনেকাংশে কমে এসেছে। মাতৃত্বকালীন ছুটি ও নারী শ্রমিকদের ওভারটাইম প্রসঙ্গে আবদুস সালাম বলেন, আগে এ বিষয়গুলো নিয়ে কারখানাগুলোতে সমস্যা থাকলেও বর্তমানে তা কমে এসেছে। আর এ ব্যাপারে কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ করলে আমরা বিষয়টি দেখব।

সমাজতান্ত্রিক শ্রমিকফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রাজ্জেকুজ্জামান রতন বলেন, পোশাক কারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিকদের এখনো নিজের দেহের সুস্থতার চেয়ে তার নিরাপত্তার কথা বেশি ভাবতে হয়। দুঃখজনক হলেও টয়লেটে যাওয়ার কথা বললে একজন নারী শ্রমিককে তার সুপারভাইজারের কাছে বকা খেতে হয়, যা কর্মক্ষেত্রে হয়রানির একটি ঘটনা। নারী শ্রমিকদের এখনো কম মজুরি দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। আবার যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার কাজে আসা যাওয়ার পথে নারী শ্রমিকদের আতঙ্কিত থাকতে হয়। সাধারণত কারখানাগুলোর একটি ফ্যাক্টরি ক্লিনিক থাকে। তবে এসব ক্লিনিকে খুব সীমিত আকারে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। সাধারণত এসব ক্লিনিকে নারীদের শুধু ব্যথানাশক ওষুধ দেওয়া হয়। ক্লিনিকের কয়েকজন চিকিৎসক জানান, বেশিরভাগ নারী শ্রমিকরা মাথাব্যথা, চোখে ব্যথা, কাঁধে ব্যথা, পিঠ ও কোমরে ব্যথাসহ ওজন হ্রাসের মতো সমস্যায় ভোগেন। এ ছাড়াও মেশিন অপারেটর নারীরা শুষ্ক কাশির সমস্যায় ভোগেন। আর নেডেল পাংচার কাজের জন্য আঙ্গুলে সুই ফুটেও অনেকে ব্যথা পান। কোয়ালিটি কন্ট্রোলার ও পোশাক ইস্ত্রি করেন যে নারী শ্রমিকরা, তারা দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে কাজ করার জন্য হাঁটু ও থাই-এর ব্যথায় ভোগেন। অনেকের শ্রবণশক্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সর্বশেষ খবর