বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

পরিবেশবান্ধব ইজিবাইক পরিবেশ নষ্টের কারণ

মাটিতে বিষ ছড়াচ্ছে পরিত্যক্ত ব্যাটারি

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

পরিবেশবান্ধব বলে স্বীকৃত যান ইজিবাইক এখন পরিবেশ দূষণের দায়ে অভিযুক্ত হচ্ছে। গ্রামেগঞ্জে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া এই যানবাহনের পরিত্যক্ত ব্যাটারি ফেলা হচ্ছে যেখানে সেখানে। আর সেই ব্যাটারিতে থাকা বিষ ছড়িয়ে পড়ছে ফসলি জমিতে। খাদ্যের মাধ্যমে সেই বিষ আবার ছড়িয়ে পড়ছে মানবদেহে। এ অবস্থায় ইজিবাইকের প্রসারে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। তারা এরই মধ্যে বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছে।

সম্প্রতি হলুদে অতিরিক্ত সিসার উপস্থিতির কারণে ভয়নাক স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং এ সমস্যা থেকে উত্তরণ সংক্রান্ত আন্তমন্ত্রণালয় সভায় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি জানান, ‘বর্তমানে ইজিবাইকের ব্যবহার অতিমাত্রায় বেড়েছে। এই যানটির ব্যাটারি ডিসপোজাল বিজ্ঞানসম্মতভাবে হচ্ছে না। যত্রতত্র এগুলো ফেলা হচ্ছে। ফলে এ থেকে মাটি দূষিত হচ্ছে।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, জেলা-উপজেলা এমন কি গ্রামেও এখন ইজিবাইকের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হচ্ছে। এই যান মূলত ব্যাটারির মাধ্যমে ব্যবহৃত হয় বলে এটি বিষাক্ত ধোঁয়া বা সরাসরি কার্বন ছড়ায় না বায়ুম-লে। এ কারণে এটিকে পরিবেশবান্ধব যান বলে অভিহিত করা হয়। ফলে এই যানটি চলাচলে জেলা প্রশাসন বা স্থানীয় প্রশাসন থেকেও বাধা দেওয়া হয় না। কিন্তু সম্প্রতি হলুদে সিসার উপস্থিতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে ভয়াবহ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। জানা গেছে, পরিবেশবান্ধব এই ইজিবাইক-ই পরিবেশ নষ্টের গোড়া। সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, একটি জেলায় গড়ে ৪০ থেকে ৫০ হাজার ইজিবাইক চলাচল করে। দেশের ৬৪টি জেলায় চলাচলরত এই ইজিবাইকগুলোর ব্যাটারির পরিত্যক্ত হওয়ার পর সেগুলো ফেলে রাস্তার পাশে বা পতিত জমিতে ফেলে দেওয়া হয়।

ইজিবাইকের পরিত্যক্ত ব্যাটারির মাধ্যমে মাটিতে বিষ ছড়ানোর বিষয়টি স্বীকার করে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান সৈয়দা সারওয়ার জাহান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। পরিবেশ দূষণকারী ইজিবাইকের ব্যাটারি যেহেতু ফুড আইটেম না, সে কারণে এখনই এর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করা যাচ্ছে না। তবে এটি যেহেতু খাদ্যের মাধ্যমে মানবদেহে বিষ ছড়াচ্ছে সে কারণে বিজ্ঞানসম্মত পরীক্ষার পর এ বিষয়ে তারা অ্যাকশনে যেতে পারবেন বলে মনে করেন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, হলুদে অতিরিক্ত সীসার উপস্থিতি সম্পর্কে আমরা যৌথভাবে আইসিডিডিআরবি এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে জানতে পেরেছি গ্রামগঞ্জে চালিত যান ইজিবাইকের পরিত্যক্ত ব্যাটারি যেখানে সেখানে ফেলা হয়। এই ব্যাটারিতে থাকা বিষাক্ত ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম এবং লেড সরাসরি ফসলি জমিতে মিশে যাচ্ছে। মাটিতে দূষণ ছড়াচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু হলুদ নয়, আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির (এসিএস) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের ১২টি দেশে উৎপাদিত চালে উচ্চ মাত্রার ক্যাডমিয়াম শনাক্ত হয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে শীর্ষে। কয়েক বছর আগে করা যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের এই গবেষণার সঙ্গে আংশিক একমত হয়েছেন দেশের বিশেষজ্ঞরাও। তবে তারা বলছেন, সব স্থানের নয়, বিশেষ কয়েকটি এলাকায় উৎপাদিত চালে ক্যাডমিয়াম রয়েছে। তারা বলছেন, ক্যাডমিয়াম বিষক্রিয়ায় ক্যান্সার, হৃদরোগ এবং কিডনি জটিলতা দেখা দিতে পারে। নিম্নমানের সার এবং শিল্পবর্জ্য থেকে ক্যাডমিয়াম চালে ঢুকে পড়ার কারণ বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। আর গ্রামেগঞ্জে এই শিল্পবর্জ্যরে প্রধান উপকরণ হচ্ছে ইজিবাইকের ব্যাটারি। দেখা যাচ্ছে যেখানে শিল্প-কারখানা নেই, সেখানেও দূষণ ছড়াচ্ছে ইজিবাইক।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ইজিবাইকের ব্যাটারি যে মাটিতে বিষ ছড়াচ্ছে এটি সায়েন্টিফিক্যালি প্রমাণ করতে হবে। এ জন্য বিভিন্ন এলাকার মাটি পরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ওই পরীক্ষার ফলাফল পাওয়ার পর ইজিবাইকের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাওয়া সহজ হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আমদানি) শাখাওয়াত হোসেন বলেন, হলুদে অতিরিক্ত সিসার উপস্থিতির পেছনে ইজিবাইকের ভূমিকা রয়েছে বলে তারা জেনেছেন। বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে যেসব এলাকার হলুদে সিসা পাওয়া যাচ্ছে তা চিহ্নিত করে মৃত্তিকা উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের সহায়তায় ওই অঞ্চলের মাটি পরীক্ষা করে তার রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরকে। রিপোর্ট পাওয়ার পর ইজিবাইকের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।

সর্বশেষ খবর