শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

সুবিধা দিয়েও কমেনি খেলাপি ঋণ

ব্যাংকিং খাতে খেলাপিরাই বারবার সুবিধা পাচ্ছেন প্রকৃত ব্যবসায়ীরা হচ্ছেন বঞ্চিত

মানিক মুনতাসির ও আলী রিয়াজ

সুবিধা দিয়েও কমেনি খেলাপি ঋণ

খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। প্রায় এক বছর ধরে ঋণখেলাপিদের নানা সুবিধা দিয়ে এলেও ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ কমাতে পারেনি সরকার। বরং এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ উল্টো বাড়ছে। ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে খেলাপিদের। আবার শত চেষ্টা করে আর বারবার হুঁশিয়ারি দিয়েও সিঙ্গেল ডিজিট সুদের হার বাস্তবায়ন করতে পারছে না সরকার। তবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, আগামী জানুয়ারি থেকেই সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার বাস্তবায়ন করা হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংকিং খাতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। এখানে খেলাপিরাই বারবার সুবিধা পাচ্ছেন। আর প্রকৃত ব্যবসায়ীরা হচ্ছেন বঞ্চিত। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। ঋণ অনুমোদন, ঋণ প্রদানসহ সামগ্রিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি বাড়াতে হবে। এ ছাড়া ব্যাংকিং খাত যারা নিয়ন্ত্রণ করছেন তাদের ব্যাপারেও সরকারকে সজাগ থাকতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যাংকগুলোর পরিচালনা বোর্ডে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ লোকদের পাঠাতে হবে।’ অন্যথায় এ খাতের চিত্র পাল্টাবে না বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, টানা ৯-১০ মাস ধরেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়েই দেশের খেলাপি ঋণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। সে হিসাবে ওই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বাড়ে ১৬ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা। আর পরের তিন মাস, অর্থাৎ এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত বেড়েছে ১ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা এবং সর্বশেষ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বেড়েছে আরও ৩ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ব্যাংকিং খাতে গত নয় মাসে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পরিমাণ ২২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে মোট ৯ লাখ ৬২ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। আর ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। অর্থাৎ নয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা। অথচ এই সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একাধিক প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে এসে খেলাপি ঋণের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংককে সতর্ক করেছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। অন্যদিকে খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য তৃতীয় পক্ষকে নিয়ে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠনেরও ঘোষণা দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত তাও কাজে আসেনি। এ ছাড়া অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি পৃথক কমিশন গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। এরপর পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও তা গঠন করা সম্ভব হয়নি। খেলাপি ঋণ না কমার পেছনের কারণ হিসেবে এসব বিষয়কেও চিহ্নিত করেছে আইএমএফ। এখন সিঙ্গেল ডিজিট বাস্তবায়নের জন্য নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এই কমিটি ব্যাংকগুলোর সমস্যা চিহ্নিত করে সুপারিশ করবে। এত দিন সিঙ্গেল ডিজিট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতে রিট ছিল। সেজন্য এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে খেলাপি কিছুটা বেড়েছে। এখন এই কমিটির সুপারিশে সিঙ্গেল ডিজিট বাস্তবায়ন হলে খেলাপিও কমে আসবে। চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে ঋণখেলাপিদের সুবিধা বাড়িয়ে নতুন নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে বলা হয়, ব্যাংকগুলো এখন থেকে চাইলে তিন বছরের মন্দমানের খেলাপি ঋণকে আর্থিক হিসাব থেকে বাদ দিতে পারবে। আর এতেই কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে পারবে ব্যাংকগুলো। একই সঙ্গে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রে মামলাও করতে হবে না। এ ছাড়া এসব ঋণের পুরোটার ওপর নিরাপত্তা সঞ্চিতিও না রাখার সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বিষয়টি পরবর্তী সময়ে আদালত পর্যন্ত গড়ালেও পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষেই রায় আসে। ফলে তা এখনো বলবৎ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে খেলাপি ঋণ কমেনি বরং বেড়েছে।

সর্বশেষ খবর