শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

শাহজালালে আজ থার্ড টার্মিনালের নির্মাণ শুরু

নিজস্ব প্রতিবেদক

থার্ড টার্মিনাল এখন আর স্বপ্ন নয়। স্বপ্ন এখন বাস্তব রূপ পেতে যাচ্ছে। বহু প্রতীক্ষিত এই মেগা প্রকল্পের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করে স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ সকাল ১০টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে। আগামী চার বছরের মধ্যেই প্রস্তুত হবে নান্দনিক আর অত্যাধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত থার্ড টার্মিনাল। আর এই টার্মিনাল চালু হলে বদলে যাবে গোটা দেশের এভিয়েশন খাত। নবদিগন্তের সূচনা হবে আকাশপথে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনায় থাকা বাংলাদেশ তখন নিজেকে প্রস্তুত করবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম হাব হিসেবে। যা গোটা দেশের অর্থনীতিকে বিকশিত ও মজবুত করতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

থার্ড টার্মিনাল নির্মাণ কাজের উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে এভিয়েশন সেক্টর এখন উৎসবমুখর। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের এই দিনটিকে আলাদা করে রাখতে চায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। উদ্বোধনের অনুষ্ঠানটি জমকালো করে তুলতে বর্ণাঢ্য মঞ্চ নির্মাণ, আলোকসজ্জার পাশাপাশি এলইডি স্ক্রিনে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে প্রকল্পের নকশা। বিজয় সরণি থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত নানা রঙের ফেস্টুন শোভা পাচ্ছে। রাতে নকশার আলোকসজ্জা শোভা পাচ্ছিল পুরো সড়কে। বেবিচক কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে আজকের এ অবস্থানে এসেছে স্বপ্নের এই থার্ড টার্মিনাল। দরপত্র চূড়ান্ত হওয়ার দিনেও মামলা ঠুকে প্রকল্প নস্যাৎ করতে চেয়েছিল একটি মহল। কিন্তু সরকারের আইনি লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত সব বাধা কাটিয়ে আলোর মুখ দেখে স্বপ্নের থার্ড টার্মিনাল। এখন থার্ড টার্মিনাল শুধু স্বপ্ন কিংবা কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ নয়; স্বপ্ন এখন রূপ পেতে যাচ্ছে বাস্তবে।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান বলেন, ‘আমরা সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। বহুল প্রতীক্ষিত এ নির্মাণ কাজের উদ্বোধনের অপেক্ষায় এখন আমরা।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিভিল এভিয়েশনের এ যাবৎ কালের বৃহৎ এই নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে গোটা এভিয়েশন মহলে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলেই পদ্মা সেতু নির্মাণের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সিভিল এভিয়েশন শুরু থেকেই তোড়জোড় চালিয়েছে। এর নির্মাণ কাজ শেষ হলে সত্যিই এক অনন্য স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন হিসেবে খ্যাতি ছড়াবে স্বপ্নের থার্ড টার্মিনাল।

কী থাকছে : চার বছর ধরেই আলোচনায় এই টার্মিনাল। তিন বছর ধরে তৈরি করা হয়েছে অত্যাধুনিক বিমানবন্দরের এই থার্ড টার্মিনাল। যা শাহজালাল বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত। এর ড্রয়িং-ডিজাইনে দেখা যায়- তিনতলাবিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিটের কম্পোজিট স্ট্রাকচার। এ ভবনে থাকবে সব ওয়ানওয়ের এন্ট্রি ও এক্সিট পয়েন্ট। ঢাকার দক্ষিণ প্রান্ত থেকে যারা আসবেন তারা নিকুঞ্জের লা মেরিডিয়ান পয়েন্ট থেকে উঠে যাবেন টার্মিনাল কানেক্টিং সড়কে। ওখানে থাকবে টার্মিনালের এন্ট্রি গেট। তিনতলা থেকে বহির্গামী যাত্রীরা এস্কেলেটরে নেমে যাবেন দোতলায়, যেখানে থাকবে বহির্গমন ও অ্যারাইভাল ইমিগ্রেশন ও চেক-ইন কাউন্টার। আবার রাজধানীর উত্তর প্রান্ত থেকে আসা যাত্রীরা বর্তমান বলাকার দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে পশ্চিম দিকে ঢুকে উড়ালসেতু দিয়ে চলে যাবেন টার্মিনাল ভবনে। একইভাবে টার্মিনাল থেকে বের হওয়ার সময় একই আন্ডারপাস ও ওভারপাস দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে নির্বিঘ্নে চলে যাওয়া যাবে।

বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সূত্র জানায়, থার্ড টার্মিনালে যাতায়াতে যানজটের বিন্দুুমাত্র কারণও থাকবে না। ট্রাফিক সিস্টেমে এমন সুযোগ রাখা হয়েছে, যা কেবল চোখে দেখার মতো, বলার মতো নয়। অত্যাধুনিক দৃষ্টিনন্দন এই টার্মিনাল হবে বিশ্বের অন্যতম আধুনিক মডেলের। ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার আয়তনের এ ভবন ও টার্মিনালে থাকবে অত্যাধুনিক লাউঞ্জ, চেক ইন কাউন্টার, গমন ও আগমনী কাউন্টার, স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট কন্ট্রোল কাউন্টার, দোকান, রেস্টুরেন্ট, শপিং মলসহ থাকবে অন্যান্য সুবিধা। থার্ড টার্মিনালে থাকবে ২৪টি বোর্ডিং ব্রিজ। বহির্গমনের জন্য ১৫টি সেলফ সার্ভিস চেক ইন কাউন্টারসহ মোট ১১৫টি চেক ইন কাউন্টার, ১০টি স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট কন্ট্রোলসহ ৬৬টি কাউন্টার, আগমনীর ক্ষেত্রে পাঁচটি স্বয়ংক্রিয় চেক ইন কাউন্টারসহ মোট ৫৯টি পাসপোর্ট ও ১৯টি চেক ইন অ্যারাইভাল কাউন্টার থাকবে। এর বাইরে টার্মিনালে ১৬টি আগমনী ব্যাগেজ বেল্ট স্থাপন করা হবে। অতিরিক্ত ওজনের ব্যাগেজের জন্য চারটি পৃথক বেল্ট স্থাপন করা হবে। গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য থার্ড টার্মিনালের সঙ্গে মাল্টিলেভেল কার পার্কিং ভবন নির্মাণ করা হবে। এতে ১০৪৪টি গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে। এ ছাড়া থার্ড টার্মিনাল ভবনের সঙ্গে ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ পথ ও উড়ালসেতু নির্মাণ করা হবে, যার মাধ্যমে মেট্রোরেল ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগ ব্যবস্থা থাকবে। এতে থাকবে আন্তর্জাতিক মানের অত্যাধুনিক অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা। বিশাল এই কর্মযজ্ঞে দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী, কারিগর, বিশেষজ্ঞ, তত্ত্বাবধায়ক ও সাধারণ শ্রমিক মিলিয়ে কমপক্ষে ৫ হাজার জনবল দিন-রাত নিয়োজিত থাকবে। চার বছরের মধ্যে নির্মাণ শেষের টার্গেট নিয়ে তারা কাজ করবে।

এই ভবনটির নকশা প্রস্তুত করেছেন স্থপতি বোহানি বাহারিন। তিনি এনওসিডি-জেভি জয়েন্ট ভেনচার পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের আওতাধীন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সিপিজি করপোরেশন প্রাইভেট লিমিটেডের (সিঙ্গাপুর) স্থপতি।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) সূত্রে জানা যায়, জাপানের মিটসুবিশি এবং ফুজিতা ও কোরিয়ার স্যামসং একটি কনসোর্টিয়ামের নির্মাণ কাজে ঠিকাদারের দায়িত্ব পেয়েছে। আগের দুই টার্মিনালের চেয়ে চারগুণ বড় এ টার্মিনাল ভবন বছরে কমপক্ষে ১ কোটি ২০ লাখ যাত্রী ধারণে সক্ষম। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ২১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। এর মধ্যে সরকারি কোষাগার থেকে পাওয়া যাবে পাঁচ হাজার কোটি টাকা এবং বাকি অর্থ জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) থেকে পাওয়া যাবে। এটি নির্মিত হলে বছরে আরও অতিরিক্ত ১ কোটি ২০ লাখ যাত্রী চলাচল করতে পারবে।

গতকাল দুপুরে নির্মাণ কাজের উদ্বোধন প্রস্তুতি পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী বলেন, থার্ড টার্মিনাল চালু হলে এটি হবে এ অঞ্চলের সেরা বিমানবন্দর। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস যেভাবে আকাশে শান্তির নীড়, আমাদের নতুন টার্মিনালও হবে শান্তির পরশ। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মহিবুল হক বলেন, ‘এত বছরেও আমরা সত্যিকার অর্থে এ খাতে উন্নয়ন করতে পারিনি। বহু প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আমরা এ জায়গায় এসেছি। এ টার্মিনাল নির্মাণ হলে বছরে ২০ মিলিয়ন যাত্রীকে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে। টার্মিনালটি এমন একটি মেকানিজমে নিয়ে আসা হচ্ছে, কোথাও একটি সুইচ নষ্ট হলে সেটা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যাবে।’ তিনি বলেন, ‘নতুন টার্মিনাল হলে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং যে কোনো সংস্থা করতে পারবে। ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে সেই কাজ দেওয়া হবে।’

সর্বশেষ খবর