রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

সিঙ্গেল ডিজিট সুদের ঋণে গতি পাবে শিল্প খাত

ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি

মানিক মুনতাসির

সিঙ্গেল ডিজিট সুদের ঋণে গতি পাবে শিল্প খাত

নতুন বছরের প্রথম দিন থেকেই ব্যাংক ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে ব্যাংকগুলো। ইতিমধ্যে যা অনুমোদনও দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা দু-এক দিনের মধ্যেই জারি করা হবে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে দেশের শিল্প ও বিনিয়োগ খাতে গতি ফিরে আসবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা। দেরিতে হলেও এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে- এটাকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। এজন্য এ সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়ন করা জরুরি বলে মনে করেন তারা। শিল্প খাতের বিপর্যয় কাটাতে এ সিদ্ধান্ত খুবই কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। বিশেষ করে প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি পণ্যের প্রসার ঘটাতে হলে পণ্যের উৎপাদন খরচ কমানো জরুরি। কেননা বাংলাদেশে উচ্চ ব্যাংক সুদ হওয়ায় উৎপাদন খরচও চড়া। ফলে প্রতিবেশী দেশগুলোর উৎপাদিত সমমানের পণ্যগুলো অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে বাজার দখল করছে। এ অবস্থা থেকে বেরোনোর জন্য ব্যাংকের সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার বিপর্যস্ত শিল্প খাতের জন্য ঘুরে দাঁড়াতে নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। এদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেসরকারি খাতের ঋণে লাগাম টেনে চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০) জন্য ২১ জুলাই মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়, যা আগের অর্থবছরে (২০১৮-১৯) ধরা হয়েছিল ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ। সে হিসাবে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা ২ দশমিক ১ শতাংশ কমানো হয়। ফলে নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর বিষয়েও আগাম চিন্তাভাবনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা শিল্প খাতকে চাঙা করতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, চক্রবৃদ্ধি সুদের চাপে অনেক ব্যবসায়ীই পথে বসার উপক্রম হয়েছেন। ব্যাংকিং খাতে যেমন স্বেচ্ছা ঋেণখেলাপি রয়েছেন, তেমন অতিরিক্ত সুুদের চক্করে পড়েও ঋণখেলাপি হয়েছেন এমন নজিরও বিদ্যমান। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের উৎকর্ষ সাধনের জন্য সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার বাস্তবায়ন হবে ১ জানুয়ারি, ২০২০ থেকেই।

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের স্বার্থে আমরা দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকের সুদহার নিয়ে কথা বলে আসছি। এত বেশি উচ্চ সুদ আর কোথাও নেই। সরকারও এটা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। শেষ পর্যন্ত এবার তা বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। এটা আমাদের শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। ব্যাংকগুলো ঠিকঠাকমতো এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে বিপর্যস্ত শিল্প খাতকে বাঁচাতে সহায়তা করবে বলে আমার বিশ্বাস।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমছে। চলতি বছরের (২০১৯) অক্টোবরে ঋণ প্রবৃদ্ধির ১০ দশমিক ০৪ শতাংশ হয়েছে। এর আগের মাস সেপ্টেম্বরে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আগস্টে ছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এর আগের মাস জুলাই শেষে ছিল ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ। জুনে ঋণপ্রবাহ ছিল ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ, মে মাসে যা ছিল ১২ দশমিক ১৬ শতাংশ। এর আগের মাস এপ্রিলে ছিল ১২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, মার্চে ১২ দশমিক ৪২ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ ও জানুয়ারিতে ছিল ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ। এর জন্য প্রধানত উচ্চ হারের সুদকেই দায়ী করেছেন ব্যবসায়ীরা। সিঙ্গেল ডিজিট বাস্তবায়ন শুরু হলে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবৃদ্ধির ধারা পাল্টে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এদিকে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবৃদ্ধি কমিয়ে চলতি অর্থবছর নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ মুদ্রানীতিকে কর্মসংস্থানমুখী প্রবৃদ্ধি-সহায়ক ও সংকুলানমুখী মুদ্রানীতি বলছেন গভর্নর ফজলে কবির। নতুন মুদ্রানীতিতে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এর মধ্যে ডিসেম্বর, ২০১৯ পর্যন্ত লক্ষ্য ঠিক করেছে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ। এখন পর্যন্ত ১৩ শতাংশের মতো অর্জিত হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এর চূড়ান্ত হিসাব পেতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানান, ব্যাংক ঋণের এক অঙ্কের সুদের বাস্তবায়ন নিয়ে হাজারো চিঠি-চালাচালি, বহু নির্দেশনা আর অসংখ্যবার বৈঠক করেও এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে অক্টোবর, ২০১৯ পর্যন্ত আলটিমেটাম দেওয়া হলেও এখনো বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংকই এটা বাস্তবায়ন করেনি। তবে সব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক এবং দু-একটি বেসরকারি ব্যাংক সরকারের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছে। আসছে নতুন বছরের প্রথম দিন থেকেই এটা শতভাগ কার্যকর করতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটা একটা জটিল ইস্যু। শুনেছি বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সে কাজ করতে পারে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে এটাও ঠিক, আমাদের দেশের ব্যাংকের সুদহার বেশ চড়া। এজন্য এটা সহনীয় হওয়া উচিত। কিন্তু সেটা কীভাবে হবে তা অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকই ঠিক করবে।’

সর্বশেষ খবর