সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

চা-পাতার ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত হাজার হাজার ক্ষুদ্র চাষি

মাহমুদ আজহার ও সরকার হায়দার, তেঁতুলিয়া (পঞ্চগড়) থেকে

চা-পাতার ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত হাজার হাজার ক্ষুদ্র চাষি

পঞ্চগড়ে চা-পাতার মূল্য দিন দিন কমছেই। চা চাষে এখন আগ্রহ হারাচ্ছে প্রান্তিক পর্যায়ের অন্তত পাঁচ  হাজার ক্ষুদ্র চাষি। পঞ্চগড়ের অর্থনীতিও এখন হুমকির মুখে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পঞ্চগড় ও আশপাশের জেলায় চা-পাতার ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে জরুরি হয়ে পড়েছে অকশন মার্কেটের। অকশন মার্কেট স্থাপিত হলে পরিবহন ব্যয়ও কমে যাবে। চাষিরাও  ভালো মূল্য পাবে। পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়াসহ বিভিন্ন উপজেলায় চা চাষ শুরু হয় ২০০০ সালে। শুরুতে বড় বাগান হলেও পরে ক্ষুদ্র চাষিরাও চায়ের আবাদ শুরু করে। ২০১৮ সালে এই জেলায় ৩ কোটি ৭৭ লাখ ২১ হাজার ৭০৪ কেজি কাঁচা চা-পাতা থেকে ৭৮ লাখ ২২ হাজার ৮৮ কেজি  তৈরি চা-পাতা উৎপন্ন হয়। ২০১৯ সালে তৈরি চা-পাতা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৯৫ লাখ কেজি। তেঁতুলিয়া উপজেলার পেদিয়াগজ এলাকার ক্ষুদ্র চা চাষি ফারুক হোসেন জানালেন, ১ হাজার কেজি কাঁচা চা উৎপাদনে খরচ হয় ১০ হাজার টাকা। কারখানায় নিয়ে গেলে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কেটে নিয়ে দাম পাই ৭ হাজার টাকা। বর্তমানে লোকসান হচ্ছে। তবে অকশন মার্কেট স্থাপিত হলে এ সমস্যা থাকবে না। জানা যায়, বর্তমানে তেঁতুলিয়াসহ পঞ্চগড়ের বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় ৫ হাজার ক্ষুদ্র চাষি চা চাষ করেছেন। তেঁতুলিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী মাহমুদুর রহমান ডাবলু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চা পাতার ন্যায্যমূল্য পাওয়ার জন্য আমরা সর্র্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে তেঁতুলিয়ায় একটি অকশন মার্কেট হলে চাষিদের কোন দুর্ভোগ থাকবে না। পঞ্চগড়ের ১৩টি চা কারখানা রয়েছে। কয়েকটি কারখানা বন্ধ রয়েছে। কারখানা কর্তৃপক্ষ প্রতি কেজি কাঁচা চা-পাতার মূল্য দিচ্ছেন মাত্র ১২ থেকে ১৩ টাকা। যদিও জেলা প্রশাসন সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে মূল্য নির্ধারণ কমিটি সর্বশেষ চা-পাতার মূল্য নির্ধারণ করে দেন, ১৬ টাকা ৮০ পয়সা। তা কারখানা মালিকরা তোয়াক্কা করছে না। কৃষকরা বলছেন, চা শ্রমিকদের মজুরি এবং সার কীটনাশকের মূল্য পরিশোধ করতে ঘর থেকে টাকা ঢালতে হচ্ছে তাদের। অনেকে চায়ের গাছ থেকে কাঁচা চা-পাতা কেটে  ফেলে দিচ্ছেন। কেউ কেউ চা চাষ করা থেকে বিরতও রয়েছেন। চাষিদের অভিযোগ, কারখানার মালিকরা সিন্ডিকেট করে কাঁচা চা-পাতার মূল্য নিয়ন্ত্রণ করছেন। দাম কম দেওয়ার পাশাপাশি কেজিতে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কাঁচা চা-পাতার মূল্য পরিশোধও করেন না। অনেক সময় কারখানা বন্ধ রাখেন। তখন চায়ের পাতা বেশি হয়ে যায়। প্রতিবাদ করলে চা-পাতা কেনা বন্ধ করে দেন তারা।  অন্যদিকে চা ফ্যাক্টরি মালিকদের দাবি, চাষিরা নিয়ম মেনে চা চাষ করছেন না। চায়ের পাতার মানও নিম্নমানের। তারপরও পঞ্চগড়ে একটি অকশন মার্কেট স্থাপন করা হলে চাষিরা কিছুটা লাভবান হবে। অকশন মার্কেট স্থাপিত হলে পরিবহন ব্যয় কমে যাবে। চাষিরাও সঠিক মূল্য পাবে। একইসঙ্গে কারখানা মালিকদের ৪/৫ পাতার বেশি কাঁচা চা-পাতা না নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হলেও তারা এই নির্দেশনা মানছেন না। বরং নানা অজুহাত দেখিয়ে চাষিদের প্রতি কেজি কাঁচা চা-পাতা কিনছেন ১০ থেকে ১২ টাকা দরে। কোথাও কোথাও ৮ থেকে ১০ পাতাও তারা কিনছেন। ফলে চায়ের মান কমে যাচ্ছে। জানা যায়, সর্বশেষ গত ৩ ডিসেম্বর সাড়ে ৪ পাতার বিপরীতে ১৬টা ৮০ পয়সা নির্ধারণ করে মূল্য নির্ধারণ করে কমিটি। জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় ১ জানুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কাঁচা চা-পাতা ক্রয় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই দুই মাস চা ফ্যাক্টরিগুলো চা পাতা কেনা বন্ধ রাখবেন। কিন্তু চা-পাতার মূল্য নির্ধারণ কমিটির সিদ্ধান্ত মানছেন না কারখানা মালিকরা। তারা কাঁচা চা-পাতা কিনছেন ১২ থেকে ১৩ টাকায়। ২০১৮ সালে পঞ্চগড়ে কাঁচা চা-পাতার মূল্য ছিল কেজি প্রতি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। কিন্তু এ বছর হঠাৎ করেই মূল্য কমে যায়। তৈরি চা কারখানার কর্তৃপক্ষ বলছেন, ক্ষুদ্র চা চাষিরা গাছ থেকে চা-পাতা সংগ্রহে নিয়ম মানছেন না। চা পাতার কালচার যথাসময়ে বজায় রাখছেন না তারা। চা-পাতার থিকনেস বাড়ানোর জন্য কেমিক্যাল ব্যবহার করায় চায়ের গুণগত মান কমে যাচ্ছে। গ্রিন কেয়ার অ্যাগ্রো লিমিটেডের ব্যবস্থাপক মঞ্জুর আলম জানান, সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে চা-পাতা প্লাকিং করার কথা থাকলেও চাষিরা চল্লিশ দিন পর পর চা-পাতা তোলেন। চাষিরা চা-পাতার পরিপক্বতা ৪ থেকে ৫ না মেনে ১০/১২-এর ওপরে পাতা সরবরাহ করছেন। ফলে চায়ের পাতার মান কমে গেছে। এ  কারণে অকশন মার্কেটে তৈরি চায়ের দর পতন ঘটেছে। ফলে কাঁচা চা-পাতার মূল্য পাচ্ছেন না চাষিরা। এ ছাড়া অতিরিক্ত মজুরি এবং সার কীটনাশক ব্যবহারের কারণে লোকশান গুনতে হচ্ছে চাষিদের। তবে অনেক চাষি এখন ৪ থেকে ৫ পাতা সরবরাহ করছেন। আমরাও এর বেশি পাতা দিলে তা গ্রহণ করছি না। বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ শামীম আল মামুন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন সারা বিশ্বেই হঠাৎ  তৈরি চা-পাতার দর কমেছে। পঞ্চগড়ে চাষিদের মধ্যে চায়ের কালচার এখনো গড়ে ওঠেনি। অধিকাংশ চাষি ভারত থেকে আনা টিবি ২৫, টিবি ২৬ চায়ের চাষ করছেন। এগুলো থেকে নিম্ন প্রজাতির চা উৎপাদন হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ টি-বোর্ড উন্নত মানের চায়ের চারা বিটি ২ সরবরাহ করছে। এখানে মজুরির দাম বেশি। হাত দিয়ে আড়াই থেকে তিন পাতা তোলার নিয়ম থাকলেও এখানে কাঁচি, দা দিয়ে চা-পাতা তোলেন চাষিরা।

সর্বশেষ খবর