মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
ফিরে দেখা ২০১৯

পিয়াজ আর চামড়ায় কেঁদেছে মানুষ

মানিক মুনতাসির

বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল দ্রব্যমূল্য, পানির দামে বিক্রি হওয়া কোরবানির পশুর চামড়া। অর্থবছরের প্রথম দিন থেকে বহুল আলোচিত ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন শুরু করেও রাজস্ব আদায়ে পিছিয়ে পড়েছে সরকার। আর বছরের শেষের দিকে প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে কাঁদিয়েছে পিয়াজ। দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা নিয়ে বছর শুরু করলেও বছরের শেষ দিকে এসে ভোক্তাসাধারণের নাভিশ্বাস ওঠায় পিয়াজ। সে কান্নার জল  এখনো ঝরছে মানুষের রান্নাঘর থেকে বাজারে। মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে ২৫ টাকা কেজির পিয়াজ কিনতে হয়েছে ২৫০ টাকায়। এখনো সেটি ১০০ টাকার ওপরে। এমনকি পিয়াজপাতাই এবার ১২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়ে পণ্যমূল্যের ইতিহাসে রেকর্ড গড়েছে। বিদেশ থেকে আমদানি করে ভর্তুকি মূল্যে টিসিবির মাধ্যমে সরবরাহ করেও পিয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে বছরের মাঝামাঝিতে আলোচনায় ছিল কোরবানির পশুর চামড়া। সিন্ডিকেটের কারসাজিতে হঠাৎ দাম পড়ে যাওয়ায় রাগে-ক্ষোভে বিপুলসংখ্যক চামড়া মাটিতে পর্যন্ত পুঁতে ফেলে সাধারণ মানুষ। এতে বঞ্চিত হয়েছে দেশের শত শত এতিমখানা আর গরিব মানুষ। আর নামমাত্র মূল্যে কিংবা বিনা মূল্যে চামড়া কিনে এ খাত থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন অসৎ ব্যবসায়ীরা। বছরজুড়েই আলোচনায় ছিল গ্রামীণ ফোন-রবি আর বাংলাদেশ টেলি কমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) অমীমাংসিত কর ফাঁকির পাওনা হিসেবে ১২৮০ কোটি টাকা বকেয়া আদায় ইস্যু। উভয় পক্ষ আদালত পর্যন্ত পৌঁছালেও বছরের শেষেও এর সমাধান হয়নি। এমনকি গ্রামীণফোনের ব্যান্ডউইথ (তরঙ্গপ্রবাহ) কমিয়ে দিলেও তারা সে অর্থ পরিশোধ করেনি। আবার আদালত ছেড়ে আলোচনার টেবিলেও সমাধান হয়নি। ফলে উভয় পক্ষই এখনো নিজ নিজ অবস্থানে অনড় রয়েছে। বিটিআরসি বলছে, টেলিফোন অপারেটর দুটি রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। ফলে এ টাকা তাদের পরিশোধ করতেই হবে। পঞ্জিকা বছরের শুরুতে কর আদায়ে বেশ সাফল্য দেখালেও অর্থবছরের মাঝামাঝি আর পঞ্জিকা বছরের শেষে এসে ঘাটতিতে পড়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ফলে অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি গুনতে হবে বলে জানিয়েছে এনবিআর। নতুন ভ্যাট আইন-২০১৬ কার্যকর করেও রাজস্ব আদায়ে সরকার কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থবছর শেষে অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া অর্থনীতির মূল সূচকগুলো স্বস্তি নিয়ে বছর শুরু করলেও বছর শেষে তা ধরে রাখা যায়নি। একমাত্র প্রবাসী আয় ছাড়া অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো এখন নিম্নমুখী। দারিদ্র্য বিমোচনে বিশ্ববাসীর কাছে ঈর্ষণীয় উন্নতি হলেও প্রধানমন্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, দারিদ্র্য বিমোচনের গুণগত মান ভালো নয়। এমনকি এ খাতের আরও বেশি প্রবৃদ্ধি হওয়া উচিত ছিল। এ জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-সচিবসহ সব স্তরের কর্মকর্তাদের আরও মনোযোগী হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার প্রতিনিয়তই বাড়ছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনের হারও বেড়েছে। উল্লম্ফন হয়েছে প্রবাসী আয়ে। একই সঙ্গে এক বছরে বেড়েছে ধনী-গরিবের বৈষম্যও। সুষম উন্নয়নের কথা বলা হলেও বাস্তবে তা হয়নি। সরকারের আয় কম হওয়ায় সরকারের ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বেড়েছে। এক বছরের ব্যাংক ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৯০ ভাগই নিয়ে নিয়েছে সরকার পাঁচ মাসে। বেসরকারি বিনিয়োগ বহু বছর ধরেই স্থবির। বিদায়ী বছরেও এর চিত্র পাল্টায়নি। সারা বছর নানা উদ্যোগ নিলেও টেনে তোলা যায়নি পুঁজিবাজারকে। বছরের প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত সূচক শুধু কমেছেই। বিনিয়োগকারীরা এক বছরে পুঁজিবাজার থেকে মূলধন হারিয়েছেন ৫৫ হাজার কোটি টাকা। বিনিয়োগে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে না আসায় শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানিও গতি পায়নি বিদায়ী বছরে। তবে খাদ্যপণ্য আমদানিতে রেকর্ড হয়েছে। বিশেষ করে বছরের শেষ দিকে এসে তুরস্ক, ইরাক, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে পিয়াজ আমদানি করতে হচ্ছে সরকারকে। এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে বিদেশে।

সর্বশেষ খবর