শনিবার, ৪ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

বাই অ্যান্ড সেল

মির্জা মেহেদী তমাল

বাই অ্যান্ড সেল

‘মিনি ড্রোন’ মাত্র ১৬০০ টাকা! আগ্রহীরা এখনই যোগাযোগ করুন। স্টক সীমিত। একটি ফেসবুক পেজে এমন বিজ্ঞাপন দেখে ঢাকার বাসিন্দা মুন্নার আগ্রহ জন্মায়। বেশ কিছুদিন ধরেই এমন একটি ড্রোনের কথাই ভাবছিলেন তিনি। মার্কেটেও ঘুরে দেখেছেন। কিন্তু দামটা একটু বেশি হওয়ায় কেনা হচ্ছিল না তার। কিন্তু ফেসবুক পেজে একই ড্রোনের মূল্য যা দেওয়া আছে তা হাতের নাগালেই তার। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই কল করলেন ফেসবুকে পাওয়া মোবাইল নম্বরে। একজন ফোন ধরতেই মুন্না জানতে চাইলেন ড্রোন সম্পর্কে। তাকে বলা হলো, চীন থেকে আনা হয়েছিল মিনি ড্রোন। অল্প কিছু তাদের কাছে ছিল। সেদিন সকালেই শেষ পিস বিক্রি হয়ে গেছে। শুনে মুন্নার মন খারাপ হয়ে গেল। বললেন, তাহলে বিজ্ঞাপন কেন দিয়েছেন? সেলার তার কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেন, স্যার, আপনার খুব প্রয়োজন হলে আনিয়ে দেওয়া যাবে। ইতিমধ্যে অর্ডার দেওয়া হয়েছে কিছু সংখ্যক। আপনি চাইলে আপনার জন্য অর্ডার দিতে পারেন। শুনে মুন্না আশ্বস্ত হন। কীভাবে অর্ডার করতে হবে, জানতে চান মুন্না। ড্রোন সেলার তাকে একটি বিকাশ নম্বর দিয়ে বলেন, আপাতত এই নম্বরে ৫০০ টাকা পাঠিয়ে দিন। এতে করে অর্ডারটা কনফারমেশন করা হবে।

শুনে আর দেরি করেননি মুন্না। ৫০০ টাকা পাঠিয়ে দেন ওই নম্বরে। টাকা পাওয়ার কথা জানিয়ে ওই নম্বর থেকে ফিরতি ফোন আসে। মুন্নাকে বলা হয়, দুই দিন পর কোম্পানি থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। দুই দিন পেরিয়ে তিন দিন হয়। মুন্নার কাছে ফোন আসেনি। চার দিনের মাথায় মুন্না সেই নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু ফোন নম্বর বন্ধ। সেই নম্বরটি আর খোলা পাননি মুন্না।

মুন্নার মতো এমনভাবে প্রতিদিনই প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে টাকা খোয়াচ্ছেন সাধারণ মানুষ। আর প্রতারক চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কদিন পর পর এমন প্রতারক চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারও করছে। কিন্তু প্রতারণা কমছে না। সিআইডি এমনই একটি চক্রের সন্ধান পেয়েছে। যারা বুকিং মানির কথা বলে টাকা হাতিয়ে নিত। এ ছাড়া কুরিয়ার সার্ভিসে তারা মালামাল পাঠালেও সেখানে অর্ডারের কোনো মাল থাকে না। গত মঙ্গলবার সিআইডি প্রতারক চক্রের তিন সদস্য যথাক্রমে- কিশোরগঞ্জের রেদওয়ান উল্লাহ, ভোলার আরিফ হোসেন ও সিরাজগঞ্জের জসিম উদ্দিনকে গ্রেফতার করে। বাই অ্যান্ড সেল, চায়না ফ্যাশন, ফ্যাশন হাব, ট্রেন্ডি শপ, লাইফস্টাইল, প্রিমিয়াম কালেকশন, সিএম ফ্যাশনস এমন বাহারি নামে ফেসবুকে পেজ খুলতেন তারা। মোবাইল ফোন, বিছানার চাদর, ব্লেজারসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য আকর্ষণীয় দামে বিক্রির বিজ্ঞাপন থাকত এসব পেজে। ক্রেতারা পণ্য পছন্দ করে অর্ডার দিতে চাইলে বিকাশের মাধ্যমে নেওয়া হতো বুকিং মানি। পণ্য হোম ডেলিভারি দেওয়ার কথা থাকলেও তারা কৌশলে কুরিয়ার সার্ভিস থেকে পণ্য তুলে নিতে অনুরোধ করত। সেখান থেকে পণ্য নিতেই ক্রেতারা দেখতে পেতেন, সরবরাহ করা পণ্যটি অত্যন্ত নিম্নমানের, নকল বা ভুয়া। ফেসবুকে পণ্য বিক্রি করার নামে প্রায় এক বছর ধরে এই চক্র এভাবেই প্রতারিত করে আসছে হাজার হাজার ক্রেতাকে। এভাবে তাদের কাছ থেকে চক্রটি হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। সিআইডি জানায়, এই চক্রটি গত এক বছর ধরে অনলাইনে শপিংয়ে মানুষের আগ্রহকে ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ফেসবুক পেজে কারও পণ্য পছন্দ হলে তাদের দেওয়া নম্বরে ফোন করে। প্রথমে পণ্যটি নিতে হলে বুকিং মানি হিসেবে ৫০ থেকে ৫০০ টাকা বিকাশের মাধ্যমে পরিশোধ করতে বলা হয় আগ্রহী ক্রেতাকে। টাকার অঙ্কটি খুব বেশি না হওয়ায় ক্রেতারাও সেই টাকা বিকাশ করে পাঠাতেন। নাম সর্বস্ব ফেসবুক পেজগুলোর জন্য তাদের বিকাশ নম্বর রয়েছে এক হাজারেও বেশি। আর তাদের কল সেন্টারের নম্বরটি ফরোয়ার্ড করা থাকে। ফলে বিভিন্ন সময় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলেও ধরা যায় না। ক্রেতার কাছ থেকে বুকিং মানি পাওয়ার পর তারা ক্রেতাকে জানাত, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পণ্যটি তার নির্ধারিত ঠিকানায় পৌঁছে যাবে। হয় তাদের ফোন নম্বর বন্ধ করে দেয়, নয়তো তারা ক্রেতার নির্ধারিত ঠিকানায় পণ্য না পাঠিয়ে নিকটস্থ কোনো কুরিয়ার সার্ভিসে পণ্যটি পাঠাত। সেক্ষেত্রে নিজের ঠিকানা ব্যবহার করত ভুয়া। এরপর ক্রেতাকে ফোন করে ডেলিভারি সার্ভিস ম্যানের অভাব অথবা অন্য কোনো সমস্যার কথা জানিয়ে কুরিয়ার থেকে নির্ধারিত টাকার বিনিময়ে পণ্যটি তুলে নিতে বলত। ক্রেতা সরল বিশ্বাসে টাকা জমা দিয়ে পণ্যটি তুলে দেখত সেটি তার অর্ডার করা পণ্য নয়। বিছানার চাদর অর্ডার করলে পাওয়া যেত গজ কাপড়, নতুন ব্লেজার অর্ডারের বিপরীতে মিলত পুরনো ব্লেজার, এমনকি মোবাইল ফোনের অর্ডার করলে মিলত ডামি ফোন! এমন পণ্য পেয়ে স্বাভাবিকভাবেই ক্রেতা ক্ষুব্ধ হতো। কল সেন্টারে ফোন করে মিলত না কোনো সমাধান। কুরিয়ারে আসা স্লিপের ঠিকানা ভুয়া হওয়ায় সেখানে গিয়েও দেখা পাওয়া যেত না কারও। এভাবেই প্রতিদিন শত শত পণ্য বিক্রির নামে এক বছরে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। প্রতারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধানে নামে সিআইডি। এক মাস ধরে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে গত ৩১ ডিসেম্বর রাতে সিআইডির টিএইচবি ইউনিট এই প্রতারক চক্রের তিন সদস্যকে রাজধানীর বাংলামোটরে অবস্থিত একটি অফিস থেকে গ্রেফতার করা হয়। এরই মধ্যে তারা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাদের অপকর্মের কথা স্বীকার করেছে। এই চক্রের কেন্দ্রে আরও অন্তত ১০ জন জড়িত রয়েছে বলে জানিয়েছে তারা। এদের ধরতে অভিযান চলছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ফেসবুক পেজের অনলাইন শপ থেকে কোনো কিছু কিনতে হলে, অবশ্যই খোঁজখবর নিয়েই কেনা উচিত। অল্প দামের ফাঁদে না পড়ে মার্কেট থেকেই প্রয়োজনীয় মালামাল কেনার পরামর্শ পুলিশ কর্মকর্তাদের।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর