মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

চতুর্মুখী সংকটে পোশাকশিল্প

অসুস্থ প্রতিযোগিতা । উদ্যোক্তারা বিপুল অর্থ ব্যয় করলেও বাড়তি দাম পাচ্ছেন না । রপ্তানিতে ধস । হারাচ্ছে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা । সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণ চাই : ড. রুবানা হক

রুহুল আমিন রাসেল

চতুর্মুখী সংকটে পোশাকশিল্প

চতুর্মুখী সংকট চলছে তৈরি পোশাকশিল্পে। রপ্তানিতে ধস নেমেছে। গেল ছয় মাসে রপ্তানির নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ঠেকেছে ৬ দশমিক ২১ শতাংশে। জানা গেছে, এ খাতের উদ্যোক্তারা শিল্পের উন্নয়নে বিপুল অর্থ খরচ করছেন। কিন্তু ক্রেতাদের কাছে পণ্যের বাড়তি দাম পাচ্ছেন না। সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবিলা করছেন উদ্যোক্তারা। নিজেদের মধ্যেও চলছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। সব মিলিয়ে পোশাকশিল্প প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারিয়েছে। এমন পরিস্থিতি উত্তরণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, খরচ কমানো ও রপ্তানি প্রবৃদ্ধির স্বার্থে অবিলম্বে সিঙ্গেল ডিজিট সুদহারে ঋণসুবিধা চেয়েছেন পোশাকশিল্পের মালিকরা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সভাপতি ড. রুবানা হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ শিল্প ঘুরে দাঁড়াতে সরকারের নীতি-সহায়তা চাই। ব্যাংক ঋণের সুদহার কমিয়ে এক অঙ্ক বা সিঙ্গেল ডিজিট করতে হবে। সরকার ও ব্যাংকের সহযোগিতা ছাড়া পোশাকশিল্প এই বিপর্যয় সামাল দিতে পারবে না। আমরা প্রতিযোগিতা সক্ষমতার জায়গাটা হারিয়ে ফেলেছি। ফলে রপ্তানি কমে গেছে। উদ্যোক্তারা বিপুল অর্থ ব্যয় করলেও বাড়তি দাম পাচ্ছেন না।’ পরিস্থিতি মোকাবিলায় পণ্য রপ্তানিতে প্রতিযোগী দেশের সঙ্গে পাল্লা দিতে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন প্রয়োজন বলেও মত দেন রপ্তানি খাতের এই শীর্ষ নেতা। তথ্যমতে, দেশের মোট রপ্তানি আয়ে পোশাকশিল্পের অবদান ৮৪ শতাংশ। ফলে পোশাকশিল্পের রপ্তানির তথ্য-উপাত্তে ফুটে ওঠে দেশের পুরো রপ্তানিচিত্র। জানা গেছে, পোশাকশিল্পে এখন ভয়াবহ বিপর্যয় চলছে। অসম প্রতিযোগিতায় অসহায় হয়ে পড়েছেন উদ্যোক্তারা। অর্ডার কমিয়ে দিচ্ছেন ক্রেতারা। বিশ্বব্যাপী চলছে মূল্য নিয়ে যুদ্ধ। সর্বশেষ মধ্যপ্রাচ্যে নতুন যুদ্ধের দামামা শুরু হওয়ায় বিশ্ব অর্থনীতিতে আরেক বড় ধাক্কার আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) দেওয়া ৫ জানুয়ারির হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, চলতি ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস বা গত ছয় মাসে পোশাকপণ্যে রপ্তানি কমেছে ৬ দশমিক ২১ শতাংশ। এই কম আয় এ সময়ের রপ্তানি বৃদ্ধির হারের তুলনায় বেশি। এই সময়ে রপ্তানি কমেছে ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রপ্তানি কম হয়েছে ১২ দশমিক ৭৭ শতাংশ। একক খাত পোশাকের আয় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম হয়েছে ১৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ। মোট ১ হাজার ৬০২ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে ছয় মাসে, গত অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭০৮ কোটি ডলার। অর্থাৎ গত ছয় মাসে পোশাক রপ্তানি কমেছে ১০৬ কোটি ডলার। জানা গেছে, দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্বজুড়ে দ্বিতীয় পোশাক রপ্তানিকারক দেশের খ্যাতি হারানোর পথে রয়েছে বাংলাদেশ। এই হার হতে পারে বাংলাদেশের বড় প্রতিযোগী বিশ্বের তৃতীয় পোশাক রপ্তানিকারক ভিয়েতনামের কাছে। পোশাকশিল্পের কয়েকজন মালিক আলাপকালে জানিয়েছেন, ব্যাংক ঋণে উচ্চ সুদ ও অসহযোগিতার কারণে আর্থিক সংকটে পড়ে চলতি বছরই বন্ধ হয়েছে অর্ধশতাধিক কারখানা। জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে বিদেশি ক্রেতাদের ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ায় শ্রমিকদের বেতন-ভাতা, মজুরি এবং অফিসের ব্যয় বহন করতে না পারায় অর্ধশতাধিক কারখানা শুধু বন্ধ হয়নি, চাকরি হারিয়েছেন হাজার হাজার শ্রমিক। কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মধ্যে বড় সমস্যা আর্থিক অসচ্ছলতা। এখন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। অনেক কারখানার মালিকরা ঠিকভাবে দরকষাকষি করতে পারছেন না পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে। অনেকে আবার অতিরিক্ত বিনিয়োগ করে আসছেন। ফলে বর্তমানে তৈরি পোশাক খাতে চরম দুরবস্থা চলছে। একের পর এক ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এটা তারা সামাল দিতে পারছেন না। এমন পরিস্থিতিতে ৩১ ডিসেম্বর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণের সুদহার কমিয়ে ৯ শতাংশে আনার সিদ্ধান্ত কার্যকরের অনুরোধ করেছে বিজিএমইএ। সংগঠনটির সভাপতি ড. রুবানা হক স্বাক্ষরিত পত্রে বলা হয়, দীর্ঘদিন ধরে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে দেশের সব ব্যবসায়ী সংগঠন, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএ থেকে দাবি জানানো হয়। ফলে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা পরিচালন খরচ কমানো, বিনিয়োগ বাড়ানো এবং প্রতিযোগী দেশের তুলনায় সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী ঋণের সুদহার কমিয়ে সিঙ্গেল ডিজিটে আনার নির্দেশনা প্রদান করেছেন। বর্তমানে দেশের বস্ত্র ও পোশাকশিল্প নিজ নিজ অবস্থান টিকিয়ে রাখাসহ নানা সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে চলেছে। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সহযোগিতার জন্য ৯ শতাংশ হারে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সুদহার আগামী ১ এপ্রিলের পরিবর্তে চলতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর একান্ত প্রয়োজন।

এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের জন্য বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএর পক্ষ থেকে অনুরোধ করা যাচ্ছে। এর আগে চলতি অর্থবছরের রপ্তানি আয়ের চিত্র পর্যালোচনা করে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গত বছর ২৮ নভেম্বর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে চিঠি দিয়েছেন। পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ওই চিঠিতে বলা হয়, চলতি অর্থবছর শেষে আয়ের প্রবৃদ্ধি গত অর্থবছরের চেয়েও কমতে পারে। পোশাকশিল্পের এ পরিস্থিতির জন্য ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রার শক্তিশালী অবস্থান দায়ী। চিঠিতে বলা হয়, চলতি অর্থবছর পোশাক খাতে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১১ দশমিক ৯ শতাংশ। প্রথম চার মাসে রপ্তানি কমেছে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ডিসেম্বর পর্যন্ত মন্থর ধারা অব্যাহত থাকতে পারে। মূল্যভিত্তিক প্রতিযোগিতায় অন্যদের সঙ্গে টিকে থাকতে না পারার কারণেই বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, চলতি অর্থবছর পোশাক খাতের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ৩ হাজার ৮২০ কোটি ডলার। তবে রপ্তানি হবে ৩ হাজার ১৯০ কোটি ডলার। অর্থবছর শেষে ৭ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হবে। এ খাতের জন্য ‘আরএমজি ফরেন কারেন্সি রিয়ালাইজেশন প্রোগ্রাম’ নামে একটি কর্মসূচি চালুর পরামর্শ দিয়ে চিঠিতে বলা হয়, ২৫ শতাংশ স্থানীয় মূল্য সংযোজনের পরিমাণ ৭৯৮ কোটি ডলার। এ অঙ্কের ওপর ডলারপ্রতি পাঁচ টাকা অতিরিক্ত বিনিময় হার নির্ধারণ করা হলে এতে লাগবে ৩ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। যদিও চলতি অর্থবছর থেকে পোশাক খাতের জন্য নতুন করে ১ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দিতে বাজেটে ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।

বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, বিগত ২০০৯-১০ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল ৯৬ শতাংশ বা ১২ বিলিয়ন ডলার। ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৩৪ শতাংশ বা ৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। দেখা যাচ্ছে, প্রতিনিয়ত এ খাতের প্রবৃদ্ধি কমছে। বিগত পাঁচ বছরে (২০১৪-২০১৮) যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ ও ইউরোপের বাজারে ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ পোশাকের দর পতন হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধিতে ভিয়েতনাম অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে রয়েছে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিসটিকস রিভিউ-২০১৯ প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), চীন, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, ভারত, তুরস্ক, হংকং, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র ৪২ হাজার ১০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে, যা মোট রপ্তানির ৮৩ দশমিক ৩ শতাংশ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে চীন। বিশ্ববাজারে দেশটির হিস্যা ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ। চীনের পরই একক দেশ হিসেবে পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষস্থানে আছে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম। বাংলাদেশ ৩ হাজার ২৯২ কোটি এবং ভিয়েতনাম ৩ হাজার ২০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। উভয় দেশের বাজার হিস্যা প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। গত বছর ১০ শীর্ষ রপ্তানিকারকের মধ্যে বাংলাদেশের বাজার হিস্যা ছিল ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্যদিকে ভিয়েতনামের বাজার হিস্যা বেড়ে হয়েছে ৬ দশমিক ২ শতাংশ।

সর্বশেষ খবর