বৃহস্পতিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

সম্ভাবনাময় কাগজশিল্প পরিণত হচ্ছে রুগ্ন খাতে

পরিকল্পনা ছাড়াই একের পর এক গড়ে উঠছে কারখানা

আলী রিয়াজ

একের পর এক কাগজের মিল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অপরিকল্পিত কারখানা স্থাপন, পাল্প আমদানিনির্ভর শিল্প, ব্যাংক ঋণের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে এ খাতে। বাংলাদেশের ছোট বাজারে চাহিদার তুলনায় বেশি উৎপাদন হওয়ায় কাগজশিল্পে তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে পুরো খাত সংকটের মুখে পড়ছে। বর্তমানে দেশে ১০৬টি কাগজের মিল রয়েছে। এর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ভালো চলছে, বিদেশে পণ্য রপ্তানি করছে। বেশির ভাগ কোম্পানি রুগ্ন হয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। ইতিমধ্যে ৫৯টি কাগজের মিল বন্ধ হয়ে গেছে। ৪৭টি মিল আংশিক চালু রয়েছে। যেখানে মুনাফা করতে না পেরে একের পর এক মিল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সেখানে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে একাধিক মিল গড়ে তোলা হচ্ছে। এতে ঝুঁকিতে পড়ছে পুরো কাগজশিল্প খাত। বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ।

জানা গেছে, দেশীয় মিলগুলো বর্তমানে চাহিদার তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ বেশি কাগজ পণ্য উৎপাদন করছে; যা মিলগুলোর উৎপাদন-সক্ষমতার চেয়ে কম। অর্থাৎ সক্ষমতার পুরোটা উৎপাদন করলে এ হার হবে আরও বেশি। রাষ্ট্রায়ত্ত কাগজকল কর্ণফুলী মিলস ক্ষমতার পাঁচ ভাগের এক ভাগ উৎপাদন করছে। এ চিত্র বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের। কাগজশিল্পের এমন পরিস্থিতির মধ্যেও একের পর এক ছোট-বড় মিল গড়ে উঠছে। একশ্রেণির ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারের যোগসাজশে ঋণ নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে নতুন নতুন কাগজের মিল। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিদেশে অর্থ পাচার ও ব্যাংক ঋণ নিয়ে অর্থ হাতানোর উদ্দেশ্যেই বিনিয়োগ করা হচ্ছে এ খাতে। বিদেশ থেকে কাগজশিল্পের মেশিনারিজ আমদানির উদ্দেশ্যই মূল। কাগজশিল্পের একেকটি মেশিনের দাম ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ দু-তিনটি মেশিন আমদানি করলে দাম বেশি দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের সুযোগ তৈরি হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একদিকে অর্থ পাচারের সুযোগ নিতেই কিছু ব্যবসায়ী কাগজশিল্পকে বেছে নিয়েছেন। অন্যদিকে কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই ব্যাংকগুলো শত শত কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে এ খাতে। ফলে অল্প সময়েই প্রতিষ্ঠানটি পণ্য বাজারজাত করতে না পেরে রুগ্ন হয়ে যাচ্ছে। পরিণত হচ্ছে খেলাপি প্রতিষ্ঠানে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পুরো কাগজশিল্পে। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন অর্থনৈতিক জোনে কাগজশিল্প স্থাপন করলে ১০ বছর পর্যন্ত কর রেয়াতের সুবিধার কারণে এ জোনের বাইরে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে। এতে বছরের পর বছর লোকসান গুনে ক্রমেই রুগ্ন শিল্পে পরিণত হচ্ছে সেগুলো। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এ শিল্পের সংকট নিয়ে একটি চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমএ)। ওই চিঠিতে বলা হয়, দেশীয় কাগজ মিলসমূহে উৎপাদন ক্ষমতা চাহিদার তুলনায় আড়াই গুণ বেশি হওয়া সত্ত্বেও নতুন মিল স্থাপন অব্যাহত রয়েছে। ফলে এ খাতের বর্তমান উদ্যোক্তাদের অধিকাংশের আর্থিক অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, তারা ব্যাংক ঋণ পরিশোধে অসমর্থ হয়ে পড়েছে। তীব্র বিপণন সংকটের কারণে বিদ্যমান কাগজ মিলগুলোর অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় নতুন নতুন কাগজ মিল স্থাপিত হলে এ খাতটি সামগ্রিকভাবে রুগ্ন শিল্পে পরিণত হবে। গভর্নর বরাবর লেখা এ চিঠিতে অনুরোধ করা হয়েছে, দেশ কাগজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছাড়াও ৩০টির বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। জাতীয় কোষাগারে এ খাতের অবদান ৩০০ কোটি টাকা। চিঠিতে সম্ভাবনাময় খাতটি রক্ষা করতে নতুন কাগজশিল্প প্রকল্পে অর্থায়ন না করার জন্য দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাংককে নির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ক্রিয়েটিভ পেপার মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফিরোজ আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বর্তমানে কয়েকটি মিল তাদের উৎপাদিত কাগজ রপ্তানি করছে। দেশে বিপণন ও বিদেশে রপ্তানি করার পরও এসব কারখানা আর্থিক সংকটে রয়েছে। দেশে দিনে দিনে কাগজের চাহিদা কমছে। এ ছাড়া সারা পৃথিবীতে কাগজের উৎপাদন খরচ ও বিপণন মূল্যের পার্থক্য খুবই কম। অর্থাৎ কাগজ পণ্য রপ্তানির পরও মুনাফা করা অনেক কঠিন। কাগজ সফট্ উড ও হার্ড উড পাল্প থেকে উৎপাদন করা হয়। হার্ড উড পাল্পের মাধ্যমে উৎপাদিত মিল বেশি বাংলাদেশে। হার্ড উড পাল্প আমদানি করা হয় মূলত ইন্দোনেশিয়া থেকে। সফট্ উড পাল্প থেকে পণ্য উৎপাদন করে বসুন্ধরা পেপার মিলস লিমিটেডসহ চার-পাঁচটি প্রতিষ্ঠান; যারা উৎপাদিত পণ্য রপ্তানিও করছে। এ সফট্ উড পাল্প আমদানি করা হয় ইউরোপ, কানাডা ও ব্রাজিল থে“ন্ডে যা খুবই উচ্চমূল্য। সরাসরি গাছ থেকে এ পাল্প তৈরি হয় বলে সারা পৃথিবীতে পাল্পের বাজার খুবই অস্থিতিশীল। বাংলাদেশে এসব পাল্প উৎপাদনের কোনো গাছ নেই। ফলে পুরো কাঁচামালই আমদানি করতে হয় সফট্ উডনির্ভর মিলগুলোকে। এতে উৎপাদন খরচ ওঠাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। দেশের বাজারে এ অস্থিরতার মধ্যেও নতুন নতুন মিল স্থাপন আরও সংকট তৈরি করছে। কোন শিল্পে কী পরিমাণ বিনিয়োগ থাকতে হবে তা বিবেচনায় নিয়েই ব্যাংকগুলোর অর্থায়ন করা উচিত।’ পেপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমির ইউসুফ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কিছু ব্যবসায়ী না বুঝে, ব্যাংক ঋণ নেওয়ার চিন্তা থেকেই কাগজশিল্পে বিনিয়োগ করছেন। দেশের বাজার এত ছোট ও প্রতিযোগিতামূলক যে বছরের ব্যবধানে নতুন কারখানা রুগ্ন হয়ে যায়। ব্যাংকের ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়। সমস্যা তৈরি হয় পুরো খাতে। এখন কাগজ বিক্রি হয় খুব কম দামে। ব্যাংকগুলোর উচিত এসব বিষয়ে বিনিয়োগের আগে নতুন করে চিন্তাভাবনা করা। আমরা যারা কোনোভাবে টিকে আছি তাদের পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।’

সর্বশেষ খবর