বৃহস্পতিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

রাতজাগা পাখি

মির্জা মেহেদী তমাল

রাতজাগা পাখি

আনিকা। একটি বেসরকারি ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। সাধারণ পরিবারের সন্তান। পরিবারের সঙ্গে খুব ভালো বন্ধন। বন্ধুদের সঙ্গেও তার ভালো সম্পর্ক। ফেসবুক সোশ্যাল মিডিয়ায় যায়, কিন্তু খুব বেশি সময় দেয় না। খেতে পছন্দ করে। একই ইউনিভার্সিটির ছাত্র ইসতিয়াক। ভালো গান গায়। গিটার হাতে খালি গলায় যখন গান গায়, মুগ্ধ হয়েই সবাই শুনে। এই ইসতিয়াকের সঙ্গে পরিচয় তার এক বান্ধবীর মাধ্যমে। ফেসবুকে ইসতিয়াকের ফ্যানপেজ আছে। নাম ‘রাত জাগা পাখি’। আনিকার সঙ্গে সেই রাত জাগা পাখির ফ্যানপেজেই কথা হয় দুজনের।

আপনাদের এই রাত জাগা পাখি ফ্যানপেজ কি ঘুম কেড়ে নেওয়ার টনিক দেয় নাকি? তাহলে এটা আমার জন্য নয়। মেসেজে জানায় আনিকা। ইসতিয়াকের জবাব, আরে না, এটা যারা রাতে জেগে থাকে তাদের জন্য। শুনে আনিকা বলে, তাহলে তো এটাতে আমি থাকতে পারব না। ইসতিয়াক বলে, সেটা পরে দেখা যাবে। এমন টুকটাক কথা চলতে থাকে দুজনের মধ্যে। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। দুজনে দেখা করে। ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে দেখা হওয়ার শুরুতেই ইসতিয়াক তাকে একটা ছোট্ট কাগজের প্যাকেট দেয়। হাতে নিয়ে আনিকা বলে, এটা কী? জবাবে ইসতিয়াক জানায়, এটা পিংক পিল। এটা খেলে রাতে জেগে থাকা যাবে। ফিগার সুন্দর থাকবে। শুনে আনিকা বলে, দরকার নেই। মোটা আছি, সেই ভালো। ইসতিয়াক তাকে জোর করে দিয়ে বলে, এটা আমার উপহার।  আনিকা ফেরত দিতে পারে না। রেখে দেয় নিজের ছোট ব্যাগে। বাসায় ফিরে তার অস্থিরতা বাড়ে। ভিষণ টেনশন তার। পিংক পিল দিয়ে কী করবে। এক সময় তার এক বন্ধু শাকিলকে ফোন দেয়। বলে, দোস্ত, পিংক পিল দিয়েছে ইসতিয়াক। কি করব এটা দিয়ে? শাকিল বলে, এটা খুব ভালো। এখন সবাই ইউজ করে। তুইও করতে পারিস। ফিগার সুন্দর হয়ে যাবে। শাকিলের কাছ থেকে ব্যবহারের নিয়ম জেনে নেয় আনিকা। এভাবেই জীবন পাল্টে যাওয়ার শুরুটা হলো পিংক পিল দিয়ে। ইসতিয়াক এখন আনিকার কাছে গানের শিল্পী নয়। তার বন্ধু। ইসতিয়াকের কাছ থেকেই পিল নিয়ে ব্যবহার করতে থাকে আনিকা। ধীরে ধীরে পালটে যেতে থাকে আনিকার রুটিন। যে মেয়েটি রাতে ঘুমাতো, সে এখন দিনভর ঘুমায়। যে মেয়েটির সঙ্গে পারিবারিক বন্ধন ছিল শক্ত, সেই বন্ধনটিও দুর্বল হতে থাকে। স্বাভাবিক হাত খরচে তার আর চলে না। পিংক পিলের চাহিদা বাড়ে তার শরীরে। টাকার প্রয়োজন পড়ে বেশি। মায়ের কাছে প্রতিদিন টাকা দাবি করে নানান অজুহাতে। তার আচরণ মায়ের কাছে সন্দেহ হয়। টাকা দেবে না বলে। কিন্তু আনিকা নাছোড়। টাকা না দিলে চিৎকার শুরু করে। বাধ্য হয়ে টাকা দেয়। টাকা পেয়ে এক মুহূর্ত আর ঘরে থাকে না আনিকা। ধানমন্ডির লেকের পাশে বসে ইসতিয়াকের সঙ্গে কথা বলছিল আনিকা। আম্মা আর টাকা দিতে চাচ্ছে না। কী করব ইসতিয়াক? ইসতিয়াক হেসে বলে, এটা ব্যাপার না। টাকা না দিলে ব্যাগ থেকে চুরি করবি টাকা। বাবা মায়ের টাকা চুরিতে কোনো পাপ নেই। পরদিন সকালেই বাসা থেকে বেরিয়ে যায় আনিকা। আনিকার বাবা অফিসে যাওয়ার আগে আনিকার কথা জিজ্ঞাস করেন। আনিকার মা তখন আলমারিতে টাকা খুঁজছিলেন। পাচ্ছিলেন না বলে তার মাথা খারাপ। তিনি বলেন, দেখ আমার টাকা পাচ্ছি না। কে নিল? আনিকার বাবা বলেন, দেখ কোথাও রেখেছ। পেয়ে যাবে। এ কথা বলেই আনিকার বাবা আহমেদ  অফিসের উদ্দেশে বেরিয়ে যান। মায়ের মনে সন্দেহ আনিকাকে নিয়ে। তিনি আনিকার রুমে যান। ঘাঁটাঘাঁটি করেন আনিকার বইপত্র। বইয়ের ভিতর থেকে একটি ফয়েল পেপারের টুকরো বেরিয়ে আসে। মাঝে পুড়ে যাওয়া কালো একটি রেখার মতো। আঁতকে ওঠেন তিনি। এমন জিনিস তিনি দেখেছেন পত্রপত্রিকা আর টিভি চ্যানেলগুলোতে। এটি ইয়াবা সেবনের জন্য ব্যবহার হয়। তার বুঝতে আর বাকি রইল না। তাদের মেয়ে ইয়াবায় আসক্ত। এ কথা ফোনে জানান আনিকার বাবাকে। একটু পর আনিকা ফিরে আসে বাসায়। মা তখন তার রুমে বসে কাঁদছে। মেয়েকে দেখেই বকা দেন। আর টাকা দেবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন মা। আনিকা বিকালে দেখা করে ইসতিয়াকের সঙ্গে। সে জানায় বুঝে ফেলেছে বাসায় নেশার কথা। টাকা বন্ধ। ইসতিয়াক বলে, ব্যাপার না। তোকে আমি দেব ৪টা পিল। একটা তোর, আর বাকি ৩টা বিক্রি করে টাকা ফেরত দিবি। রাত জাগা পাখি ফ্যান পেজেই অনেক কাস্টমার আছে, পেয়ে যাবি। এভাবে চলে আনিকার কিছুদিন। সাধারণ একটি মেয়ে আনিকা এখন আর সেবনকারী নয়, ইয়াবা ব্যবসায়ী। ইসতিয়াক তাকে অফার করে বড় একটা ডিল করতে। ঢাকার একটি মার্কেটে দিয়ে আসতে হবে একটি ইয়াবার চালান। তবেই অনেক টাকা আসবে। বসে বসে ইয়াবা খাবে। টাকা আর খুঁজতে হবে না। একদিন একটি চালান আনিকার কাছে দেওয়া হয়। দূরে থাকে ইসতিয়াক। মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আনিকা। আসবে কেউ টাকা নিয়ে, চালান সে হাতবদল করবে। একটু পর আসে সেই ক্রেতা। ব্যাগ থেকে ইয়াবার প্যাকেট বের করে আনিকা। কে জানত যারা এসেছে তারা ক্রেতা নয়, পুলিশ। হাতকড়া পরল আনিকার হাতে। ঢাকার একটি থানার পুলিশ ছদ্মবেশ নিয়ে গ্রেফতার করে আনিকাকে। ইসতিয়াক পালায়। কয়েকমাস পর জামিনে ছাড়া পায় আনিকা। জেল থেকে তার বাবা মা তাকে ছাড়িয়ে এনে রিহ্যাবে পাঠায়। আনিকা ইয়াবার আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসে। নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে। ডাক্তারদের সাহায্যে আনিকা আবার ফিরে আসে স্বাভাবিক জীবনে। ঝরে যেতে যেতে বেঁচে যায় একটি জীবন। গংশ্লিষ্টরা বলছেন, আনিকা হয়তো এ যাত্রায় বেঁচে গেছে, কিন্তু কজন পারে ফিরে আসতে। আনিকার মতো এমন অসংখ্য সাধারণ মেয়েকে প্রতিনিয়ত  ফাঁদে পড়ে অন্ধকার জীবনকে বেছে নিতে হয়েছে। রাত জাগা পাখির মতো অনেক পেজ রয়েছে, যারা ভালো কোনো কিছু ছবি বা গল্প দিয়ে তরুণ সমাজকে আকৃষ্ট করছে। একটা সময় এই তরুণদের নিয়ে যায় অন্ধকার কোনো গলিতে। যেখান থেকে কেউ ফিরে আসতে পারলেও অধিকাংশই পারে না। তথ্য প্রযুক্তি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফ্যানপেজের এডমিন সম্পর্কে না জেনে কোনো পেজে যুক্ত হওয়া যাবে না। কারন, পেজের উপরের ভাগ যেটা দেখা যায়, সেটা আসল নাও হতে পারে। রাত জাগা পাখির মতো পর্দার আড়ালে হয়তো রয়েছে ভয়ঙ্কর কোনো কিছুর হাতছানি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর