রবিবার, ১২ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

আবেগের খেসারত

মির্জা মেহেদী তমাল

আবেগের খেসারত

বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ব্রেকআপ হয়ে গেছে রাফিয়ার। সব সময় মনমড়া হয়ে বসে থাকত। লেখাপড়ায় মন নেই। তার বান্ধবীরাই তাকে বোঝাতে থাকে। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয় রাফিয়া। স্কুল, ক্লাস পরীক্ষা, আড্ডা, ঘুরে বেড়ানো- এসব নিয়ে আবারও ব্যস্ত সময় কাটাতে থাকে রাফিয়া।

হঠাৎ একটি ফোন কল- আবারও এলোমেলো রাফিয়া। ভীষণ অস্থির। অপরিচিত একটি নাম্বার থেকে অজ্ঞাত ব্যক্তি তাকে ভয় দেখায়। তাকে বলে, ‘রাফিয়া আপনি ভালো আছেন? আমার হাতে এখন আপনার সেই সব ছবি। যেসব ছবি আপনার পরিচিতরা দেখলে আপনি মুখ দেখাতে পারবেন না। লজ্জায় বাসাতেই বসে থাকতে হবে। ছবিগুলো দেখে আমার ভালো লাগছে। আপনার বাবা-মায়ের কি ভালো লাগবে?’ এ কথা শুনেই মাথা ঘুরে যায় রাফিয়ার। কণ্ঠটা আগে কখনো শোনেনি রাফিয়া। তবে কে এই লোক? যেন আকাশ ভেঙে পড়ে রাফিয়ার মাথায়। ফোনের ওপাশ থেকে লোকটি বলে ওঠে, ‘কী ব্যাপার চুপ মেরে গেলেন যে! মনে পড়েছে নিশ্চয়ই?’ রাফিয়া মুখ খোলে। সাহস নিয়ে বলে, ‘কে বলছেন আপনি। কীসের ছবি? কার ছবি? আমার তো কোনো ছবি কারও কাছে থাকার কথা নয়।’ এ কথা শুনেই লোকটি হাসতে হাসতে বলে, ওকে ডিয়ার! নো প্রবলেম। ছবি যখন সবাই দেখবে, তখন বুঝতে পারবেন কীসের ছবি, কার ছবি। রাফিয়া এবার ঘাবড়ে যায়। বলে, ভাইয়া প্লিজ এসব করবেন না। তাহলে আমার অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। কিন্তু লোকটি কিছুই শুনতে চাচ্ছে না। বলে, ৫০ হাজার টাকা দিলে এসব ছবির কোনো অস্তিত্ব আর থাকবে না। আপনি কখন টাকাটা দেবেন, জানাবেন। আমি পরে ফোন দেব। এ কথা বলেই ফোনের লাইন কেটে দেয়। গত ডিসেম্বরে ঠান্ডার দিনেও ঘেমে একাকার রাফিয়া। কী করবে, ভাবতে পারছে না। রাফিয়া মনেও করতে পারছে না, কোন ছবির কথা লোকটি বলছে। এর পরই আবারও নিজেকে সান্ত¡না দেয় এই ভেবে যে, হয়তো তার ফেসবুক হ্যাকাররা হ্যাক করেছে। সেখান থেকে ছবি নিয়ে এখন টাকা দাবি করছে। সেই রাতে রাফিয়ার ইনবক্সে ম্যাসেজ আসে। তার ছবি। ছবিটি দেখে আঁতকে ওঠে রাফিয়া। বুক কাঁপে। এটা তো তারই ছবি! কিন্তু কীভাবে লোকটির কাছে গেল! এটা তো ফেসবুকে থাকার কথা নয়। খোলামেলা ছবি। কিন্তু কীভাবে সম্ভব হলো এটা!

রাজধানীর স্বনামধন্য একটি স্কুলের ছাত্রী রাফিয়া নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। ঘর বন্ধ করে কান্না করতে থাকে। কী করবে বুঝতে পারে না। এরই মধ্যে ফোন কল আসতে থাকে। ছবি প্রকাশের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের চেষ্টা চলে। এমন বিপদের মধ্যেও বাবা-মা বা পরিবারের কোনো সদস্যকে ঘটনা জানাতে পারে না রাফিয়া। বন্ধুদের বলতেও লজ্জা পায় এবং থানা-পুলিশের কাছে যেতেও ভয় পায় সে। একপর্যায়ে রাফিয়া তার এক বন্ধুর খালার সঙ্গে যোগাযোগ করে। তার পরামর্শে ধানমন্ডি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে। অতঃপর যোগাযোগ হয় কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল (সিসিটিসি) ইউনিটের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের সঙ্গে। জিডির কপি নিয়ে হাজির হয় মিন্টো রোডে সিসিটিসির কার্যালয়ে। সেখানে ঘটনা শোনা এবং লিখেও নেওয়া হয়। তাকে বলা হয় আবার ফোন এলেই সেই অজ্ঞাতনামা লোকটিকে ধরতে বের হবে সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের টিম। ফোন আসার পর রাফিয়া টাকা পৌঁছে দেওয়ার স্থান ও সময় জানতে চায়। এর পর চলে অভিযান। রাফিয়া পৌঁছার আগেই টাকা দাবি করা লোকটি আটক হয়। লোকটিকে দেখে হতবাক রাফিয়া। আরে এ তো তার সেই বয়ফ্রেন্ড! যে কিনা ছবি প্রকাশ করে দেবে বলে দিন-রাত ফোন করে তাকে ভয় দেখাচ্ছিল। তখন মনে পড়ে যায় রাফিয়ার, সেই একদিন খুব রিকোয়েস্টের পর সেসব ছবি তাকে পাঠিয়েছিল। তখন বুঝতে পারেনি, এ ছবিগুলোই এক সময় তার রাতের ঘুম হারাম করে দেবে। জীবন হবে এলোমেলো। রাফিয়া তখন বুঝতে পারে, বন্ধু নির্বাচনে সে চরম ভুল করেছিল। আবেগে এক সময় তার কথামতো ছবিগুলো পাঠিয়েছিল। আর এ বন্ধুটিই টাকা আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছিল ছবিগুলো। একই ধরনের ঘটনার শিকার হন সুবর্ণা। সারোয়ারের (ছদ্মনাম) সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই প্রতারণার শিকার হতে থাকে সুবর্ণা। ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমোতে ছবিগুলো পাঠায় সারোয়ার। পরে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করার ভয় দেখিয়ে টাকা দাবি করে। ৭০ হাজার টাকা হাতিয়েও নেয় সে। আরও নানাভাবে প্রতারণা করতে থাকে। একপর্যায়ে সুবর্ণা বুঝতে পারে সারোয়ারের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে পুলিশের শরণাপন্ন হতে হবে। এক বন্ধুর সহায়তায় গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে। পুরো ঘটনা শোনার পর তাকে সংশ্লিষ্ট থানায় জিডি করতে বলা হয়। এর পর পুলিশের অভিযানে সারোয়ার আটক হয়। তার পরিবারের সদস্যদের মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে ডেকে আনা হয়। যে ছবিগুলোকে প্রতারণার হাতিয়ার বানানো হয়েছিল সেগুলো উদ্ধার হয়। সুবর্ণার কাছ থেকে প্রতারণা করে নেওয়া টাকাও ফিরিয়ে দেয় সারোয়ারের পরিবার।

রাফিয়া বা সুবর্ণা নয়, এমন ঘটনা এখন ঘটছে প্রতিদিন। টিনএজ বয়সের মেয়েরা ফাঁদে পা দিয়ে ব্লাকমেইলিংয়ের শিকার হচ্ছে। তবে ক্ষতিগ্রস্তদের বেশিরভাগই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মুখোমুখি হতে চান না। আবার জিডি করলেও মামলা করতে চান না তারা। সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করা ইউনিট, বিভাগ ও কমিশন বলছে, সাইবার অপরাধের শিকার হওয়ার পর যারাই সহায়তা চেয়েছে তারাই নিরাপদ হতে পেরেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, টিনএজ একটি কমনীয় বয়স, নমনীয় সময়। মেয়েরা এ সময় থাকে সরল, এ সময়েই মেয়েরা তাদের সৌন্দর্য সম্পর্কে সচেতন হয়। ফলে কেউ তাদের রূপের প্রশংসা করলে সহজেই অভিভূত হয়। অনেক পুরুষই এর ফায়দা লোটে। সরলতার সুযোগ নিয়ে করে অনৈতিক কাজ। আর এ থেকে রক্ষা করতে পারে প্রথমে বাবা-মায়েরাই। বাবা-মায়েদের তাদের মেয়েকে প্রলোভনের ফাঁদ সম্পর্কে অবহিত করতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর