সোমবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

পরিকল্পিত উন্নয়নে বদলে যাচ্ছে স্বর্ণদ্বীপ

শিমুল মাহমুদ, স্বর্ণদ্বীপ, হাতিয়া থেকে ফিরে

পরিকল্পিত উন্নয়নে বদলে যাচ্ছে স্বর্ণদ্বীপ

নানা উন্নয়ন কর্মকান্ডে বদলে যাচ্ছে স্বর্ণদ্বীপ -বাংলাদেশ প্রতিদিন

পরিকল্পিত উন্নয়নে বদলে যাচ্ছে সম্ভাবনার স্বর্ণদ্বীপ। গরু, ভেড়া, মহিষের বাথান, হাঁস, মুরগি, কবুতর ও মাছের খামার, পরিকল্পিত নারিকেল বাগান, সবজি বাগান দেখে মনেই হবে না এক সময় এই জায়গাটায় বঙ্গোপসাগরের উত্তাল জলস্রোতের দাপাদাপি ছিল। সেই সাগরের বুকে প্রাকৃতিকভাবে জেগে উঠেছে এক বিস্ময়কর দ্বীপ। আয়তনে যা প্রায় সিঙ্গাপুরের সমান। দৈর্ঘ্যে ২৮ কিলোমিটার, প্রস্থে ১৪ কিলোমিটার। স্বর্ণদ্বীপ নামের এই বিশাল দ্বীপের স্বচ্ছ পানির পুকুরে ভেসে বেড়াচ্ছে হাজারো হাঁসের ঝাঁক। মহিষ চড়ছে খোলা মাঠে। গরু, ভেড়া, হাঁস, মুরগি, কবুতরের খামার রয়েছে জায়গায় জায়গায়। রয়েছে সবজি বাগান, বিশাল নারিকেল বাগান, ধানসহ নানা ধরনের শস্য উৎপাদন ক্ষেত্র। গত বছর ৩৫০ একর জমিতে ৪৫০ হাজার মণ ধান উৎপাদন হয়েছে। এখন টার্গেট ১০ হাজার একর জমিকে কৃষিকাজের আওতায় নিয়ে আসা। এ পর্যন্ত ৩৫ হাজার সেনাসদস্য স্বর্ণদ্বীপে প্রশিক্ষণ সুবিধা পেয়েছেন। দ্বীপটি সারা বছর ব্যবহার উপযোগী রাখার জন্য কর্মপরিকল্পনা নিতে সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যাতে এই দ্বীপে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মিলিটারিরাও প্রশিক্ষণ সুবিধা নিতে পারে। বৃহস্পতিবার স্বর্ণদ্বীপে রণকৌশল মহড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হয়ে এসব উদ্যোগ ও পরিকল্পনার কথা জানা যায়। নোয়াখালীর মূল-ভূখ- থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে, সন্দ্বীপ থেকে ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে এবং হাতিয়া থেকে ১৩ কিলোমিটার উত্তরে স্বর্ণদ্বীপের অবস্থান। ঝাউ আর কেওড়া গাছ দিয়ে ঘেরা এ চরটির পুরোটাই জুড়ে আছে অসংখ্য ছোট-বড় খাল। ১৯৭৮ সাল থেকে গত ৪২ বছরে পর্যায়ক্রমে মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে উঠেছে এই বিশাল ভূখ-। চারপাশে অথই জলের প্রবাহ। মাঝখানে স্বর্ণ সম্ভাবনার এই বিশাল ভূখন্ডে এখন বহুমুখী নির্মাণ কর্মকান্ড চলছে। তিনটি সাইক্লোন শেল্টার নির্মিত হয়েছে। আরও দুটির কাজ চলছে। একটি ৩১ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে। ১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র বৃহস্পতিবার উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী। ১৯১২ সালে স্বর্ণদ্বীপ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বরাদ্দ দেয় সরকার। ২০১৪ সাল থেকে সেখানে সেনাসদস্যদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এর পাশাপাশি সেনাবাহিনী সেখানে চারটি হেলিপ্যাড নির্মাণ করেছে। ছয় বছরের প্রচেষ্টায় জনবিরল এলাকাটি বাসযোগ্য ও সবুজে সুশোভিত হয়ে উঠেছে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে গড়ে তোলা হয়েছে পরিকল্পিত বনায়ন, সাইক্লোন শেল্টার, সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প, নারিকেল বাগান, ঝাউ বাগান। ২৬টি খামারে প্রায় ১৩ হাজার মহিষ, ১৬ হাজার ভেড়া ও ৮ হাজার গরু পালন করা হচ্ছে। এসব খামার থেকে উৎপাদিত দুধ সংগ্রহ করে দুগ্ধজাত পণ্য তৈরি করতে একটি কারখানাও স্থাপিত হয়েছে। সমতল ভূমির এই দ্বীপে মাছ চাষের জন্য তৈরি করা হয়েছে অনেক পুকুর। সব মিলিয়ে অবকাঠামো উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় ‘স্বর্ণদ্বীপ’ যেন সত্যিকারের স্বর্ণদ্বীপে রূপান্তর হচ্ছে। মূল ভূখ- থেকে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপে নৌপথে চলাচলের জন্য সেনাবাহিনী নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি করেছে ৩টি ট্রলার। এ ছাড়া ভারী যানবাহন পারাপারের জন্য এলসিটি ও এলসিইউ জাহাজ ব্যবহার করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পরিকল্পিত অর্থায়ন ও সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে স্বর্ণ সম্ভাবনা বয়ে আনতে পারে স্বর্ণদ্বীপ। দ্বীপটির চারপাশে উঁচু বাঁধ দিয়ে এবং নিবিড় বনায়নের মাধ্যমে বৃক্ষবলয় সৃষ্টি করে সারা বছর এটি ব্যবহারোপযোগী করে তোলা যায়। এর ফলে এটি ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের তা-ব থেকে রক্ষা পাবে। সারা বছর এই দ্বীপে প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কর্মকান্ড অব্যাহত রাখা যাবে। ফলে নতুন আয়বর্ধক প্রকল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে স্বর্ণদ্বীপ প্রকৃত অর্থেই অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে আসতে পারে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এর একাংশ ঘিরে গড়ে উঠতে পারে পরিকল্পিত পর্যটন কেন্দ্র। আন্তর্জাতিক মানের একটি মিলিটারি ট্রেনিং একাডেমিও গড়ে তোলা যেতে পারে সেখানে। অবশ্য ইতিমধ্যে সেসব কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ২০১২ সালেই স্বর্ণদ্বীপের প্রায় ১০ হাজার একর জমি সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে সেনাবাহিনীর নিজস্ব উদ্যোগে বনাঞ্চল ও দ্বীপটির দুর্গম এলাকায় বোম্বিংয়ের মাধ্যমে কেওড়া গাছের বীজ ছড়ানো হয়। স্বর্ণদ্বীপে ৬০ হাজার ঝাউ গাছ, ভিয়েতনাম থেকে সিয়াম জাতের ১৫০০ নারিকেল চারা, কয়েক হাজার ফলদ গাছ রোপণ করা হয়েছে। এখানে মহিষের দুধ থেকে উৎপাদিত পনির স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে জেলার বাইরে সরবরাহ হচ্ছে। স্বর্ণদ্বীপ রক্ষায় ১০০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে নির্মিত সাইক্লোন শেল্টারের প্রতিটিতে ২০ হাজার গ্যালন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং (বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ) এবং সোলার বিদ্যুৎ ব্যবস্থা চালু ও বজ্রপাত নিরোধক স্থাপন করা হয়েছে। স্বর্ণদ্বীপে ইতিমধ্যে নোয়াখালী বন বিভাগের উদ্যোগে ৮০০ হেক্টর এলাকা বনায়ন করা হয়েছে। পাশাপাশি সেনাবাহিনীর উদ্যোগে ১১৬ হেক্টর এলাকা বনায়ন করা হয়েছে। দ্বীপটিকে স্বর্ণদ্বীপ নামকরণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার দরবার শুরুর আগে সে ঘটনাও বললেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, আমি দেখলাম যে এখানে জলদস্যুদের খুব উৎপাত ছিল। জাহাইজ্জার চর নামটি সেই জলদস্যুদের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। এটি ভালো শোনায় না। এ জন্য দ্বীপটির নাম দিলাম স্বর্ণদ্বীপ। আমাদের সেনাবাহিনী দ্বীপটিকে সত্যিই স্বর্ণদ্বীপে পরিণত করছে। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, আমরা গত বছর এখানে ৩৫০ একর জমিতে ৪৫০ হাজার মণ ধান উৎপাদন করেছি। পর্যায়ক্রমে এখানে ১০ হাজার একর জমি চাষাবাদের আওতায় নিয়ে আসা হবে। তিনি বলেন, এখানকার গবাদিপশুর মাংস দেশের মানুষের প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করছে।

সর্বশেষ খবর