শিরোনাম
বুধবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

দূষণে ব্যবহার অনুপযোগী কীর্তনখোলার পানি

রাহাত খান, বরিশাল

দূষণে ব্যবহার অনুপযোগী কীর্তনখোলার পানি

দিন দিন দূষিত হচ্ছে কীর্তনখোলা নদী। নগরীর অভ্যন্তরের বিভিন্ন খাল ও ড্রেন থেকে কল-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য, ময়লা, আবর্জনায় ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে কীর্তনখোলার নির্মল পানি। এর ওপর আবার শত শত নৌযানের লাখ লাখ যাত্রীর মানববর্জ্য নদীর পানিকে করে তুলেছে বিষাক্ত। এ জন্য জনসচেতনতার অভাবকে দায়ী করেছেন ভুক্তভোগীরা। তারা এখনই নদীদূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। এদিকে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে কীর্তনখোলার দূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছে বরিশালের পরিবেশ অধিদফতর ও জেলা প্রশাসন। নগরীর অভ্যন্তরে ২৪টি খাল আর কীর্তনখোলা নদীর তীরবর্তী নির্মল পরিবেশের জন্য বরিশালকে একসময় বলা হতো প্রাচ্যের ভেনিস। কিন্তু খালগুলো দখল-দূষণের কারণে ড্রেনে পরিণত হয়েছে। বাসাবাড়ির স্যুয়ারেজ লাইনের সংযোগ দেওয়া সেই ড্রেনগুলো মিশেছে কীর্তনখোলায়। যে যেভাবে পারছে ময়লা-আবর্জনা, মানববর্জ্য ফেলছে খালে-নদীতে। এতে বিপন্ন হচ্ছে আশপাশের পরিবেশ। ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে কীর্তনখোলার পানি। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, নগরীর নথুল্লাবাদ থেকে সাড়ে ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ জেলখাল পোর্ট ব্রিজের নিচে মিশেছে কীর্তনখোলা নদীতে। এ খালের দুই ধারের কয়েক হাজার বসতবাড়ির স্যুয়ারেজ লাইনের সংযোগ সরাসরি দেওয়া হয়েছে জেলখালে। এসব সংযোগ থেকে অনবরত খালে পড়ছে মানববর্জ্যসহ বিভিন্ন ময়লা-আবর্জনা। খাল হয়ে যাবতীয় ময়লা-আবর্জনা, মানববর্জ্য গিয়ে পড়ছে কীর্তনখোলা নদীতে।

শুধু জেলখাল নয়, একইভাবে পলাশপুর খাল, ভাটার খাল, চাঁদমারী খাল এবং সাগরদী খাল থেকেও সরাসরি কীর্তনখোলায় মিশছে নগরীর সাত লাখ মানুষের ময়লা আবর্জনা, পশুর বর্জ্য, কল-কারখানার বর্জ্য এবং মানববর্জ্য। নগরীর চরকাউয়া খেয়াঘাট বাজারের সব মুরগির দোকানের উচ্ছিষ্ট-বর্জ্যও সরাসরি ফেলা হচ্ছে নদীতে। খালগুলো থেকে নদীতে পড়ছে পলিথিনও।

কীর্তনখোলা নদীতে ভাটার খাল যেখানে মিশেছে সেই ডিসি ঘাট এলাকার চা-দোকানি মো. সোহেল বলেন, একটি ওষুধ কারখানার বর্জ্য, ভাটার খালের দুই পাশের সব বাসাবাড়ির ল্যাট্রিন-ড্রেনের বর্জ্য, আশপাশের মানুষের ফেলা পলিথিন, ময়লা-আবর্জনা সবই ভাটার খাল হয়ে কীর্তনখোলা নদীতে পড়ছে। এসব দেখার কেউ নেই। স্থানীয় বাসিন্দা মো. মাছুম শরীফ বলেন, ১০-১৫ বছর আগে কীর্তনখোলা নদীর পানির যে রকম ছিল, এখন সে রকম নেই। আগে মানুষ এই নদীর পানি রান্না ও গোসলসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করত। ময়লা আবর্জনা ও বর্জ্য ফেলায় এখন কীর্তনখোলা নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে পড়ছে।

এদিকে যাত্রীবাহী নৌযানগুলো বরিশালসহ বিভিন্ন নদীবন্দরে যাত্রা শেষ করার পর এগুলো ঝাড়ু দিয়ে যাবতীয় ময়লা-আবর্জনা, প্লাস্টিক-পলিথিন ফেলা হয় নদীতে। এই পলিথিন গিয়ে ঠেকছে নদীর তলদেশে। এতে ধীরে ধীরে পলি পড়ে নাব্যতা হারাচ্ছে নদী। নৌযান শ্রমিক নজরুল ইসলাম বলেন, পলিথিন-ময়লা নদীর তলদেশে গিয়ে নাব্যতা কমে যায়। নৌযানের পাখায় (প্রোপেলার) পলিথিন আটকে যায়। এতে অনেক সমস্যা হয়। এমভি কীর্তনখোলা-২ লঞ্চের কেরানি আবুল হোসেন লিটন বলেন, ‘নদীর পানি আগের মতো নেই। দূষিত হয়ে গেছে। এ জন্য আমরা সবাই দায়ী। এভাবে চলতে থাকলে পরিবেশ বিপর্যয় হবে।’

বরিশাল বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম-পরিচালক (নৌ সংরক্ষণ ও পরিচালন) এস এম আজগর আলী বলেন, নদীর সর্বত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলা হয়। বিশেষ করে বন্দর এলাকায় পলিথিন-প্লাস্টিক বর্জ্য নদীর তলানিতে গিয়ে জমে। পলিথিন-প্লাস্টিকের কারণে ড্রেজিংয়ে অনেক সমস্যা হয়। নদীর নাব্যতাও কমে যায়।

বরিশাল বিভাগীয় পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবদুল হালিম বলেন, নগরীর সব খাল ও ড্রেন থেকে কল-কারখানার বর্জ্য, মানববর্জ্যসহ ময়লা-আবর্জনা সরাসরি নদীতে পড়ছে। সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন এবং পরিবেশ অধিদফতর সমন্বিতভাবে নদীর দূষণ রোধে উদ্যোগ নেবে। নৌযানের উচ্ছিষ্ট ময়লা-আবর্জনা ঝাড়ু দিয়ে নদীতে ফেলার বিষয়টি পরিবেশ অধিদফতর অবগত ছিল না। এ বিষয়ে লঞ্চমালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে আধুনিক প্রক্রিয়ায় নৌযানের বর্জ্য অপসারণ করা হবে। আর লঞ্চযাত্রীদের বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলার বিষয়টি আগে নজরে না এলেও এখন ভাবার সময় এসেছে। এ বিষয়েও লঞ্চমালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে বিমানের মতো পরিবেশবান্ধব উপায় খুঁজে বের করার কথা বলেন তিনি।

বরিশালের জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র রহমান বলেন, অবকাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে নৌযানগুলোর মানববর্জ্য বিমান কিংবা ট্রেনের মতো অন্যত্র ফেলার বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। অচিরেই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে। নৌযান থেকে উচ্ছিষ্ট ময়লা-আবর্জনা নদীতে ফেলার বিষয়টি কঠোর হাতে দমন করার কথা বলেন তিনি।

সর্বশেষ খবর