বুধবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক নির্মাণের তামা গায়েব!

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক নির্মাণে তামা গায়েবের অভিযোগ উঠেছে। তিন শহীদ শিক্ষক ও বঙ্গবন্ধুর রিলিফ ভাস্কর্য নির্মাণে এক হাজার ৪০০ কেজি তামার বদলে ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র ৪৯২ কেজি। এ ছাড়া শৈল্পিক পরামর্শক কমিটি নিজেরাই শিল্পী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে- এমন তথ্য উঠে এসেছে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে। এ কাজে আছে প্রায় কোটি টাকা খরচে নানা অনিয়মের অভিযোগও।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৫৫তম সিন্ডিকেট সভায়। এরপর বিভিন্ন সময়ে এর নির্মাণকাজের জন্য ৮২ লাখ ৬৫ হাজার টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৭৬ লাখ ৪৮ হাজার টাকা ছাড় হয়েছে ব্যাংক থেকে। এই স্মৃতিফলকের সামনের অংশে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ তিন শিক্ষক- ড. সুখরঞ্জন সমাদ্দার, ড. হবিবুর রহমান ও মীর আবদুল কাইয়ূমের ভাস্কর্য। এর বামপাশে নিচের দিকে বসানো হয়েছে বঙ্গবন্ধুর রিলিফ ভাস্কর্য। আর পেছনে আছে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত নানা সংগ্রামের চিত্র। ২০১৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর এই স্মৃতিফলকের উদ্বোধন করেন তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মিজান উদ্দিন। এদিকে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহান দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন করে আলোচনায় আসে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক নির্মাণকাজের বিষয়টি। এরপর ফাইন্যান্স কমিটির সুপারিশে ২০১৭ সালের ৩১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ৪৭৩তম সিন্ডিকেট সভায় ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেমকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। এই কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান খান ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক বিশ্বনাথ শিকদার। তবে প্রায় দুই বছরের মাথায় গত বছরের ৮ ডিসেম্বর তদন্ত প্রতিবেদনটি ওঠে সিন্ডিকেট সভায়। প্রতিবেদনে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত ও অভিযোগ সম্পর্কে পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের লিগ্যাল সেলে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা। ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রিলিফ ভাস্কর্যটি স্থাপনে  ফাইন্যান্স কমিটির সুপারিশে সিন্ডিকেট সভায় পাস করা হয়। কিন্তু জাতির পিতা বুদ্ধিজীবী ছিলেন না এবং স্মৃতিফলকে যে স্থানে তার ভাস্কর্যটি সঠিকভাবে স্থাপন করা হয়নি। সিন্ডিকেট সভায় রিলিফ ভাস্কর্যের যে চারটি নকশা আলোচিত হয়, সেগুলোতে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ছিল না। তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পূর্বধারণা অনুযায়ী ভাস্কর্যগুলোতে এক হাজার ৪০০ কেজি তামার প্রয়োজন। কিন্তু শৈল্পিক পরামর্শ কমিটির আহ্বায়ক তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছেন, ৮৫০ কেজি তামা কেনা হয়। এর মধ্যে ওয়েস্টেজ দেখিয়েছেন ২০-২৫ শতাংশ। কাস্টিং করার সময় দুর্ঘটনাজনিত কারণে ১২০ কেজি তামা নষ্ট হয়েছে। অন্যভাবে নষ্ট হয়েছে আরও ২৬ কেজি। অর্থাৎ ব্যবহার হয়েছে মাত্র ৪৯২ কেজি। এ ছাড়া সিভিক/শৈল্পিক কাজের জন্য টেম্পার্ড গ্লাসের এস্টিমেট ছিল তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা। টেম্পার্ড গ্লাসের কোনো তথ্য পায়নি তদন্ত কমিটি। কেনাকাটায় পিপিআরের কোনো শর্তই মানা হয়নি। প্রকল্পে অর্থ খরচেও অনিয়ম পেয়েছে তদন্ত কমিটি। তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, অর্থ খরচের কোনো বিল/ভাউচার বা রেজুলেশন ও রেজিস্ট্রার দেখাতে পারেনি নির্মাণ কমিটির সদস্যরা। প্রতিটি ক্ষেত্রে নগদ অর্থ প্রদান করা হয়েছে। এস্টিমেট অনুযায়ী কোন খাতে কত টাকা খরচ হয়েছে তাও স্পষ্ট নয়।

এই স্মৃতিফলক নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন- ভূ-তত্ত্ব ও খনি বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম, রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক তারিকুল হাসান, উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক শহিদুল আলম, প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম সাউদ, ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক হেলাল উদ্দীন, প্রাচ্যকলা ও ছাপচিত্র বিভাগের অধ্যাপক ঋতেন্দ্র কুমার শর্মা, কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সুভাষ চন্দ্র সূতার, মৃৎশিল্প ও ভাস্কর্য বিভাগের অধ্যাপক ফজলুল করিম ও একই বিভাগের অধ্যাপক একেএম ময়নুল ইসলাম। তদন্ত কমিটির তথ্যমতে, স্মৃতিফলক নির্মাণকাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী ও তার প্রতিনিধির কোনো অংশগ্রহণমূলক ভূমিকা ছিল না। কমিটির সদস্যরা নিজেরাই সব কাজ করেছেন। এসব কারণে ভবিষ্যতে আর্থিক যে কোনো কাজ থেকে উল্লিখিত শিক্ষকদের বিরত রাখারও সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।তবে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক নির্মাণ কমিটির প্রধান সমন্বয়ক অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, এখানে কোনো ধরনেরই অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়নি। এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নির্মাণ কমিটির কাছ থেকে কোনো হিসাবও নেয়নি। তাহলে তদন্ত কমিটি কীভাবে অনিয়ম বা দুর্নীতি খুঁজে পেল? এই কমিটির সদস্যরা আগের উপাচার্য অধ্যাপক মিজান উদ্দিনের অনুসারী হওয়ায় বর্তমান উপাচার্যপন্থিরা অহেতুক নাজেহাল করার চেষ্টা করছেন বলেও মন্তব্য তার। আর স্মৃতিফলকের শিল্প সমন্বয়ক অধ্যাপক ফজলুল করিম বলছেন, তদন্ত কমিটিতে কোনো এক্সপার্ট নেই। এই কমিটির কোনো সদস্যরই শিল্প সম্পর্কে একাডেমিক ও ব্যবহারিক কোনো জ্ঞান নেই। তাই তারা এমন উদ্ভট অভিযোগ তুলেছেন। এখন পর্যন্ত স্মৃতিফলকের শিল্পীরা তাদের পারিশ্রমিকও পাননি বলে জানান তিনি।

এ নিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহান ও উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়া কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে প্রক্টর অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন সিন্ডিকেট সভায় আলোচিত হয়েছে। পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পরামর্শ শাখায় পাঠানো হয়েছে।

সর্বশেষ খবর