বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

ভারতের বিনিয়োগ নীতিতে এক কাতারে বাংলাদেশ-পাকিস্তান

আপত্তি জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

ভারতের বৈদেশিক বিনিয়োগ নীতিতে দুটি দেশ ছাড়া বিশ্বের আর সব দেশ সরাসরি বিনিয়োগের সুযোগ পাচ্ছে। কেবল বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করতে চাইলে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন নিতে হয়। বিষয়টিতে বিব্রতবোধ করছে সরকার। পাকিস্তানের মতো বন্ধুরাষ্ট্র বাংলাদেশকে বিধিনিষেধের আওতায় রাখার বিষয়টিতে আপত্তি জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেইসঙ্গে দেশটিতে বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের জন্য অবাধ সুযোগ চাওয়া হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের ব্যক্তি বা কোম্পানি যাতে ভারতে অন্য দেশগুলোর মতো স্বয়ংক্রিয়ভাবে (অটোমেটিক রুট) বিনিয়োগ করতে পারে সে বিষয়টি বিবেচনা করতে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে আমরা সরাসরি বিনিয়োগের (এফডিআই) বিষয়টি নিয়ে জোরালোভাবে কথা বলেছি। আমাদের দিক থেকে যুক্তি উপস্থাপনের পর ভারত এটিকে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ইস্যু হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং তারা এটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবে বলেও আশ্বাস দিয়েছেন।’

ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল পলিসি অ্যান্ড প্রমোশন থেকে সর্বশেষ যে বৈদেশিক বিনিয়োগ নীতি করা হয়েছে তার ৩.১.১ অনুচ্ছেদে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এ দুটি দেশের বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করতে হলে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। এ ছাড়া ২.১.৩৫ অনুচ্ছেদেও ‘পারসন অব ইন্ডিয়ান অরিজিন’-এর ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে নেতিবাচক তালিকায় রাখা হয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, দেশটির বৈদেশিক বিনিয়োগ নীতিতে দুই ধরনের সুযোগ রাখা হয়েছে। একটি হচ্ছে সুনির্দিষ্ট (সরকার কর্তৃক উল্লিখিত) খাতে অবাধ বিনিয়োগ সুবিধা (অটোমেটিক রুট) যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে করার সুযোগ রয়েছে, দ্বিতীয়টি হচ্ছে সরকারের অনুমতি নিয়ে (গভর্নমেন্ট রুট) বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ, যেটি মূলত এক ধরনের ‘বিধিনিষেধ’-এর মধ্যে পড়ে। পরেরটির তালিকায় কেবল বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে রাখা হয়েছে।

সূত্রগুলো জানান, গত ১৫ ও ১৬ জানুয়ারি দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত দ্বিপক্ষীয় সচিব কমিটির বৈঠকে এ বিষয়টি নিয়ে জোরালো আপত্তি জানায় বাংলাদেশ। ওই সময় যুক্তি দিয়ে বলা হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা ও ট্রানজিট ইস্যুতে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে একযোগে কাজ করছে। উপরন্তু দুই দেশের সরকার একটি অংশীদারিত্বমূলক অর্থনৈতিক চুক্তি (সিপা) করার বিষয়েও নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো একটি বন্ধুরাষ্ট্রকে অন্য একটি দেশের সঙ্গে (ভারতের জন্য স্পর্শকাতর) বিধিনিষেধের তালিকায় রাখার বিষয়টি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, যদিও বাংলাদেশ সরকার এ দেশের ব্যক্তি ও কোম্পানিগুলোকে বিদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করছে; কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনায় বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে; তার পরও বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে ভারতে বিনিয়োগের এই বিধিনিষেধ বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে ‘নেতিবাচক’ প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

‘এমনকি অন্য কোনো দেশের বিনিয়োগকারী যখন ভারতের এফডিআই পলিসি পর্যালোচনা করবে তখন পাকিস্তানের পাশে বাংলাদেশের নাম দেখে তার মনে ভুল ধারণা জন্ম নিতে পারে’- জানান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা।

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, পাশের নেপাল, ভুটান এমনকি ভারতের বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনও স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিনিয়োগের সুযোগ পাচ্ছে। পাকিস্তানের পর কেবল বাংলাদেশই এ সুযোগ পাচ্ছে না। এ ধরনের তালিকার বিষয়টি যদিও নতুন নয়, তার পরও বাংলাদেশকে পাকিস্তানের পাশে একই তালিকায় রাখার কারণে এটি দ্বিপক্ষীয় ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে দিল্লি থেকে বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠিও পাঠিয়েছে বলে জানান তিনি।

সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, কাশ্মীরসহ নানা ইস্যুতে ভারত ও পাকিস্তান এ দুই দেশের মধ্যে সময় সময় যুদ্ধাবস্থা চালু থাকে। দেশ দুটির মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কও তলানিতে। ফলে ভারতের নিরাপত্তার কারণেই পাকিস্তানিদের বিনিয়োগে বিধিনিষেধ থাকতে পারে। কিন্তু যে ভারত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেছে এবং ৫০ বছর পর যখন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, তখন ভারতে বিনিয়োগে পাকিস্তানের পাশে একই বিধিনিষেধের তালিকায় বাংলাদেশকে রাখার বিষয়টিতে বিব্রতবোধ করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা।

সর্বশেষ খবর