শিরোনাম
বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা
নদীর কান্না

দখলে-দূষণে করতোয়া

আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া

দখলে-দূষণে করতোয়া

দখল ও দূষণে মরছে বগুড়ার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত করতোয়া নদী -বাংলাদেশ প্রতিদিন

একসময় নদী ছিল। এখন হয়ে গেল ড্রেন। আর ড্রেন হওয়ার সুযোগে ইচ্ছেমতো দখল শুরু করে উচ্চ, সুউচ্চ, টিনশেড ভবন তৈরি করা হয়েছে। কোথাও কোথাও আবার নদীর মধ্যেই সীমানাপ্রাচীর দিয়ে দখল করে ভবন তৈরি করা হচ্ছে। দখলে-দূষণে মরে গেছে করতোয়া নদী। ঢেউ নেই, পানি নেই, পাড় নেই। এসবের বদলে আছে পাড়ে সুউচ্চ ভবন, অবৈধ দখলদার, বাড়িঘর, অবৈধ স্থাপনা, নদীর বুকে ময়লা আর শহরের বর্জ্য ফেলার সহস্র ড্রেনেজ ব্যবস্থা। পানি দূষিত হওয়ার কারণে মাছ নেই। নদীকে আর নদী বলে মনে হয় না। দেখলে মনে হয়, যেন শহরের সবচেয়ে বড় ড্রেন। নদী বাঁচাতে জেলা প্রশাসন কিছু দখলদার উচ্ছেদ করলেও আবারও গড়ে উঠছে নানা ভবন। জানা যায়, প্রায় ১৮০ কিলোমিটার তীর ঘেঁষে প্রাচীন পু-্র নগরীর গোড়াপত্তন হলেও সেই সভ্যতার সঙ্গে এখন করতোয়া নদী ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিতে চলেছে। করতোয়া নদী বগুড়া শহরের বুক চিরে প্রবাহিত হয়ে জেলার শেরপুর উপজেলার চান্দাইকোনায় বাঙালি নদীতে গিয়ে মিলেছে। উৎপত্তিস্থল থেকে এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮০ কিলোমিটার। এর মধ্যে দূষণ, দখল, ভরাট, পানিপ্রবাহ না থাকায় এটি মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৮৮ সালে বন্যার সময় তৎকালীন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশে গাইবান্ধার গোাবিন্দগঞ্জ উপজেলা সদরের খুলশিচাঁদপুর এলাকায় বাঁধ ও ¯ুøইস গেট নির্মাণের মাধ্যমে করতোয়া নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা হয়। সে সময় ওই অংশে করতোয়ার মূল স্রোত একটি শাখানদীর মাধ্যমে বাঙালি নদীর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল। এতে গোবিন্দগঞ্জ থেকে বগুড়ার দিকে করতোয়া নদীর প্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে দিনে দিনে সরু খালে পরিণত হয়। একদিকে পানিশূন্যতায় প্রবাহ বন্ধ, অন্যদিকে ভরাট আর দখলের ফলে নদীটি এখন মৃত। শহরের ভিতর নদীর অংশে যে যেখানে পেরেছে দখল ও ভবন নির্মাণ করেছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনেই দখল করে নদীর ভিতর বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এদিকে শুষ্ক মৌসুম আসার আগেই করতোয়া নদীতে পানিশূন্যতা দেখা দিয়েছে। দু-একটি স্থানে পানি দেখা গেলেও শহর ও শহরতলির প্রায় ২০ কিলোমিটারে শুধু ড্রেনের কালো পানি বয়ে যাচ্ছে। দখল করা নদীর তীরের পাশে নির্মাণ করা হয়েছে শত শত বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বিশাল বিশাল ভবন। সময়-সুযোগমতো প্রভাবশালীরা নামে-বেনামে নদীর তীর দখল করে নিচ্ছে।

বগুড়া শহরের নদীপাড়ের বাসিন্দারা জানান, পাড় দখল হয়ে আছে স্বাধীনতার আগে থেকেই। কেউ ড্রেন করেছে, কেউ করেছে বাড়ি। এ ছাড়া বগুড়া পৌরসভার বড় বড় ড্রেনেজ ব্যবস্থাও করা হয়েছে করতোয়া নদীতে, যে কারণে শহর এলাকার এই নদীতে আর মাছ পাওয়া যায় না। শহরের বউবাজার এলাকার বাসিন্দা আবদুল আজিজ জানান, করতোয়া নদী দখল হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রশাসন থেকে মাঝে কয়েকবার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হলেও পরে অনেকেই সেই স্থানে অস্থায়ীভাবে ঘর তুলেছে। নদীতে বর্ষা মৌসুম বা বন্যার সময় ছাড়া পানি দেখা যায় না। নদীর তলায় এখন ড্রেনের কালো পানি দেখা যায়। এখন এটিকে নদী না বলে বড়সড় ড্রেন বলা ভালো। নদী থেকে প্রতিদিন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। শহরের বড়গোলা এলাকার বাসিন্দা আবদুস সালাম জানান, তিনি একসময় নদীতে নৌকা চলতে দেখেছেন। নদীতে মাছ ছিল। এখন সেই নদীতে মাছ তো দূরের কথা, পানির দিকে তাকানো যায় না। বর্ষাকালে কিছু সময় পানি দেখা গেলেও সেটিও খুব বেশিদিন স্থায়ী হয় না। বৃষ্টিপাত কম হলেই নদীর পানি কালো হয়ে যায়। শহরের বেশির ভাগ ড্রেন নদীতে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। পাড়ে নির্মাণ করা হয়েছে বাড়িঘর।

শহরের মালতীনগরের খলিলুর রহমান জানান, নদীর পানি বাড়িঘরের উচ্ছিষ্ট দিয়ে ভরা। কালো নোংরা পানি। দখল করে ঘরবাড়ি করার কারণে নদীর অবস্থা খুবই করুণ। নদীকে আর নদী বলে মনে হয় না।

বগুড়া জেলা প্রশাসনের রাজস্ব শাখা সূত্র জানায়, শহরের মধ্যে করতোয়া নদীর কয়েকটি স্থানে দখল হয়েছে। নদী দখল হয়ে যাওয়া স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে বাড়িঘর ও ড্রেন। সব মিলিয়ে দখল করা জমির পরিমাণ সাড়ে পাঁচ একর। করতোয়া নদী দখলের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সর্বশেষ বেশ কয়েকজন দখলদারের নামের তালিকা তৈরি করা হয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। আবারও অভিযান পরিচালনা করা হবে। নদীর স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে কিছু পরিকল্পনাও করা হচ্ছে।

বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান জানান, করতোয়া নদীর প্রাণ আনতে একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। বগুড়ার করতোয়া নদীর পাড় দখলকারীদের বিরুদ্ধে প্রথম ধাপে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। শিগগিরই দ্বিতীয় ধাপে উচ্ছেদ চালানো হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর