শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

রাজধানীর ৩৯ খাল নিশ্চিহ্ন

১১ খাল এখন নর্দমা, কেনাবেচা হয়েছে চার খাল, আরও ১৫ খাল বিপন্ন দশায়

সাঈদুর রহমান রিমন

রাজধানীর ৩৯ খাল নিশ্চিহ্ন

দখল-দূষণে বাউনিয়া খাল -বাংলাদেশ প্রতিদিন

শেষ আট বছরে ঢাকার ১১টি খাল পরিণত হয়েছে খোলা নর্দমা আর ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে। আবর্জনায় জমাটবাঁধা খালের নর্দমায় খুঁটি পুঁতে পাটাতন বসিয়ে একের পর এক বস্তি গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে স্থায়ীভাবে আটকে গেছে পানিপ্রবাহের পথ। আবার কোনো খালের একটু দূরে দূরেই বাঁধ দিয়ে ঘর তুলে বদ্ধ ডোবায় পরিণত করা হয়েছে। ৩০-৩২ বছর আগেও ঢাকার প্রান্তসীমায় স্রোতবাহী যেসব খালে পণ্যবাহী বড় বড় নৌকার আনাগোনা ছিল, সে খালগুলো এখন দুই-আড়াই ফুট চওড়া ড্রেনের আকার ধারণ করেছে। খোদ ঢাকা ওয়াসা বলছে, দখলবাজদের আগ্রাসী থাবায় মাত্র ৩০ বছরেই     অন্তত ৩৯টি খালের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এমনকি সরকারি ওই দফতরে বহু খোঁজাখুঁজি করেও খালগুলোর নথি পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, ওয়াসার একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশেই প্রভাবশালী মহল বছরের পর বছর ধরে খাল দখলের মচ্ছব চালিয়ে আসছে। তারা প্রথমেই খালের নির্দিষ্ট কোনো পয়েন্টে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়। পরে বাঁধ ঘেঁষে রাতারাতি গড়ে তোলা হয় একের পর এক বস্তিঘর। ওয়াসা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে খালের মূল নথিপত্র বের করে সে আদলেই মালিকানা-সংক্রান্ত জাল কাগজপত্র বানিয়ে নেয় তারা। এর পরই বস্তিবাসীকে খালের অন্য অংশে হটিয়ে সে জায়গা প্লট আকারে বিক্রি করে দেয় তারা। এভাবেই বাঁধ দেওয়া, বস্তি স্থাপন এবং খালের জায়গা প্লট আকারে বিক্রির ধান্দাবাজি প্রক্রিয়ায় ঢাকার খালগুলো সব নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। পানিপ্রবাহের পথগুলোর অস্তিত্ব না থাকায় কয়েক মিনিটের বৃষ্টিতেই রাজধানীজুড়ে নজিরবিহীন নাগরিক বিপর্যয়ের সূত্রপাত ঘটে। রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকা এক কোমর পানির নিচে ডুবে যায় এবং সেচপাম্পের মাধ্যমে সে পানি অপসারণে ওয়াসার তিন-চার দিন পর্যন্ত সময় লেগে যায়। এর পরও দখলবাজদের কবল থেকে উদ্ধার হয় না খালগুলো, সচল হয় না পানিপ্রবাহের পথ। খাল উদ্ধারের নামে রাজউক, সিটি করপোরেশন, ওয়াসা ছোট-বড় অনেক অভিযান চালিয়েও তেমন কোনো সুফল পায়নি। আভিযানিক কর্মকর্তাদের কেউ কেউ উচ্ছেদের পরিবর্তে নিজেদের পকেট ভারী করার দিকেই বেশি উৎসাহী থাকেন। প্রভাবশালী দখলবাজদের সঙ্গে গোপন লেনদেন সম্পন্ন হলে মাঝপথেই আটকে যায় উচ্ছেদের অভিযান। ফলে তাদের কব্জা থেকে খালগুলো মুক্ত করাও আর সম্ভব হয় না। নদী, খাল, জলাধার উদ্ধারের সরকারি ঘোষণা শুধু নোটিস ও মাইকিংয়ের মধ্যেই আটকে থাকে। এ ছাড়া নদী, খাল, জলাধার দখল ও ভরাটের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ায় দিন দিনই দখলবাজরা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

আট বছরে ১১ খাল হয়েছে খোলা নর্দমা : জানা গেছে, বেশির ভাগ খালের মধ্যে পরস্পরের যোগসূত্র ছিল। এগুলোর সংযোগ ছিল রাজধানী লাগোয়া প্রধান চারটি নদীর সঙ্গে। যেমন সূত্রাপুর লোহারপুল হয়ে বুড়িগঙ্গা, মোহাম্মদপুরের বছিলা হয়ে বুড়িগঙ্গা, উত্তরার আবদুল্লাহপুর ও উত্তরখান হয়ে তুরাগ, খিলক্ষেত ডুমনি হয়ে বালু এবং মানিকনগর হয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর সঙ্গে খালগুলোর সংযোগ ছিল। এ সবই এখন বিস্মৃত অতীত। উত্তরা আবাসিক এলাকা থেকে উত্তরখানের ভিতর দিয়ে টঙ্গী খালে গিয়ে পড়া কসাইবাড়ী খালটি বর্তমানে ড্রেনে রূপান্তরিত হয়েছে। সাংবাদিক কলোনি খাল, মহাখালী খাল, বাসাবো খাল, কল্যাণপুর খাল, গুলশান, ধানমন্ডি, মেরাদিয়া ও গজারিয়া খাল এখন জীর্ণ নালার পরিচয়েও যেন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারছে না। আবদুল্লাহপুর খালটি হরিরামপুর, রানাভোলা, আবদুল্লাহপুর, উত্তরা, দলিপাড়া হয়ে বাউনিয়ায় তুরাগ নদে গিয়ে মিশেছে। রাস্তা ও রাজউকের প্লটের কারণে খালটি এরই মধ্যে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে এখন ছোট ছোট ডোবায় পরিণত হয়েছে। উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টর অংশে লেকের উত্তর প্রান্ত আবর্জনায় ভরাট করে সেখানে প্লটও তৈরি করা হয়েছে। উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরের দক্ষিণ পাশ দিয়ে বহমান খালটি এখন পুরোপুরি নর্দমায় পরিণত হয়েছে। রাজধানীর পূর্বাঞ্চলের মান্ডা খাল সবুজবাগ থেকে শুরু হয়ে মাদারটেক, দক্ষিণগাঁওয়ের পাশ দিয়ে বালু নদীতে মিশেছে। ৯ থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত প্রস্থ এবং পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ মান্ডা খালটি দখল-দূষণে অনেক আগেই সংকুচিত হয়েছে। বিভিন্ন পয়েন্টে খালের জায়গাও ব্যক্তিমালিকানার সম্পত্তিতে পরিণত হয়ে গেছে। খাল কীভাবে ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তি হলো, এর কূলকিনারা বের করতে পারেনি ওয়াসা। রাজধানীর মোহাম্মদপুর-সংলগ্ন বছিলা খাল ও সংলগ্ন জলাশয় এবং বুড়িগঙ্গা নদীর দুই পাড় দখল করে এরই মধ্যে ভরাট করে নেওয়া হয়েছে। প্রভাবশালী দখলবাজদের বিরুদ্ধে স্থানীয় বাসিন্দারা কেউ টুঁ-শব্দটি করতেও সাহস পান না। ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, মাত্র এক যুগ আগেও শাহবাগ থেকে বড় মগবাজার পর্যন্ত পরীবাগ খাল, বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্ক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত আরামবাগ খাল এবং গোপীবাগ থেকে উৎপত্তি হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছন দিয়ে আরামবাগ খাল পর্যন্ত গোপীবাগ খাল ছিল। সময়ের ব্যবধানে খালগুলো সড়কে পরিণত হয়েছে। রাজাবাজার খাল, শাহজাহানপুর খাল, গুলশান-বনানী খাল, ধানমন্ডি খাল, দক্ষিণগাঁও-নন্দীপাড়া খাল, রাজারবাগ-নন্দীপাড়া খাল, নাসিরাবাদ-নন্দীপাড়া খাল, নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী খাল, বাউখার খাল ও গোবিন্দপুর খাল এখন অস্তিত্বহীন।

সরকারি উদ্যোগেই নিশ্চিহ্ন বাউনিয়া খাল : জবরদখলে প্রায় মরে যাওয়া বাউনিয়া খালটি এখন বৃহত্তর মিরপুরবাসীর জন্য স্থায়ী অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবার খোদ সরকারি উদ্যোগ-আয়োজনেই জবরদখলে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে বাউনিয়া খাল। মিরপুর-১৪ থেকে গোড়ান চটবাড়ী পর্যন্ত ১০-১১ কিলোমিটার দীর্ঘ এ খালের প্রস্থ ৬০ ফুট। পুরাতন এয়ারপোর্ট, মিরপুর, পল্লবী, কাফরুল, ভাসানটেক ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকার সমুদয় পানি নিষ্কাশনের প্রধান পথ বাউনিয়া খালে সারা বছরই স্বচ্ছ পানির স্রোত বয়ে বেড়াত। কিন্তু ভূমি মন্ত্রণালয়ের চলমান ভাসানটেক পুনর্বাসন প্রকল্প ও গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের জয়নগর প্রকল্পের নামে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে বাউনিয়া খালের অস্তিত্ব। খালের সিংহভাগ অংশ জবরদখল করে এসব প্রকল্পের বেশ কয়েকটি বহুতল ভবন গড়ে তোলার উদ্যোগেই পানিপ্রবাহের পথ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ৬০ ফুট প্রশস্তের খালটির অনেক জায়গায় এখন ৫-১০ ফুট নালার অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যায় না। সিটি করপোরেশন, ওয়াসা আর মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একের পর এক চিঠি চালাচালি, যৌথ সভা, সীমানা নির্ধারণ, কোনো কিছুতেই কিছু হয়নি, মুক্ত হয়নি খাল। জনপ্রতিনিধি, সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় বাসিন্দাদের শঙ্কা, এই খাল দ্রুত দখলমুক্ত না হলে বর্ষায় তলিয়ে যাবে এসব এলাকা। শুধু বর্ষা নয়, শুষ্ক মৌসুমেও তৈরি হবে স্থায়ী জলাবদ্ধতা।

বিক্রি হয়ে গেছে শাহজাদপুর খাল : গুলশান লেক থেকে সুতিভোলা খালের সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী শাহজাদপুর খালটির বড় অংশই কেনাবেচা হয়ে গেছে। কাগজে-কলমে ৩০ ফুট প্রস্থের এ খালটি পূর্ব দিকে শাহজাদপুর কালভার্ট হয়ে খিলবাড়িরটেক কালভার্ট পর্যন্ত ক্ষীণকায় চেহারা দীর্ঘদিন ধরে রেখেছিল। খাল উন্নয়নের নামে মাত্র ১৫-১৬ ফুট পাকাকরণ হয়েছে, খালপাড়ের বাকি জায়গা তুলে দেওয়া হয়েছে প্রভাবশালীদের হাতে। বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী সহস্রাধিক কোটি টাকার সরকারি খালের জায়গা ওয়াসা কর্মকর্তা আর ঠিকাদারের যোগসাজশে ১০-১২ কোটি টাকাতেই বিক্রি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। শাহজাদপুর খালটি আবার প্রগতি সরণির নিচ দিয়ে কালভার্টের পশ্চিম পাশে পৌঁছেই বহুতল ভবনগুলোর মধ্যে হারিয়ে গেছে। গোপীপাড়া থেকে গুলশান লেক পর্যন্ত খালটির আর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। খালের ওপরই হয়েছে ১৫-১৬ তলা উঁচু উঁচু ছয়-সাতটি ভবন। শাহজাদপুর কালভার্ট থেকে গুলশান লেক পর্যন্ত সংযোগ খালটি জুড়ে এখন ঘন ঘিঞ্জি মহল্লা। এখানে গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক বাড়ি।

সর্বশেষ খবর