রবিবার, ১ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা
জেলার রাজনীতি নওগাঁ

প্রাণবন্ত আওয়ামী লীগ, ঘাঁটিহারা বিএনপি

বাবুল আখতার রানা, নওগাঁ

রাজশাহী বিভাগের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা নওগাঁ। নয়টি চক বা জনবসতির সমন্বয়ে গঠিত ‘নয় গাঁ’ কালক্রমে নওগাঁ হয়েছে। এ জেলায় রয়েছে ছয়টি সংসদীয় আসন, ১১টি উপজেলা ও তিনটি পৌরসভা। জেলাজুড়ে রাজনীতির মাঠ দখলে থাকায় প্রাণবন্ত আওয়ামী লীগ। একদা নওগাঁর পরিচয় ছিল ‘বিএনপির ঘাঁটি’ নামে; সেই দিন আর নেই। জেলার সর্বত্র একচ্ছত্র আধিপত্য আওয়ামী লীগের। তবে আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে প্রকাশ্যে কোনো দূরত্ব না থাকলেও কর্মীদের কাছে টানতে একে অন্যের বিরুদ্ধে ভিতরে ভিতরে বিষোদগার ছড়ান অনেকেই। শক্তিশালী প্রতিপক্ষ না থাকায় নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছেন- এমন মন্তব্য রাজনীতিসচেতন ব্যক্তিদের। তাই সিনিয়র নেতারা একই টেবিলে বসেন কিন্তু গ্রুপিং রয়েছে কর্মীদের ভিতর। নওগাঁ-১ আসনের এমপি খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার। তার এলাকায় নেতা-কর্মীদের মধ্যে তেমন বিভেদ বা দ্বন্দ্ব নেই। কিন্তু নওগাঁ-২ আসনের এমপি শহীদুজ্জামান সরকারের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। ধামইরহাট ও পত্নীতলা উপজেলার বেশ কয়েকজন নেতার ওপর ভর করে চলেন তিনি। এদের প্রধান পত্নীতলার ঘোষনগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইউপি চেয়ারম্যান আবু বক্কর। দলের যে কোনো সিদ্ধান্তে বক্কর প্রভাব খাটান বলে অভিযোগ তৃণমূল নেতা-কর্মীদের। নওগাঁ-৩ আসনের এমপি ছলিম উদ্দিন তরফদারের বিপরীতে সাবেক এমপি ডা. আকরাম হোসেন চৌধুরীর প্রকাশ্য অবস্থান সব সময়। নওগাঁ-৪ আসন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে এক কমিটি দিয়ে কাজ চালানোর ফলে সংগঠন অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। স্থানীয়ভাবে সৃষ্টি হয়েছে গ্রুপিং। ক্ষমতায় টিকে থাকতে সবকিছু কুক্ষিগত করে রেখেছেন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এ আসনে সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী বর্তমান এমপি মুহা. ইমাজ উদ্দীন প্রামাণিক বয়সের ভারে অনেকটা নুয়ে পড়েছেন। ২০০৫ সালে সিলেকশনের মাধ্যমে উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে এমদাদুল হককে সভাপতি ও জসিম উদ্দিনকে সাধারণ সম্পাদক করে ত্রিবার্ষিক সম্মেলন করার পর থেকেই তিনি বিতর্কিত। আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আবদুল জলিলের ছেলে ব্যারিস্টার নিজাম উদ্দীন জলিল জন নওগাঁ-৫ আসনের এমপি। তিনি বয়সের দিকে সর্বকনিষ্ঠ হলেও বাবার রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজগুলো করার চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক এমপি আবদুল মালেককে মাঠে চোখে পড়ে না। নিজের মতকে প্রাধান্য দেওয়া এবং নেতা-কর্মীদের অবজ্ঞা করাসহ নানা কারণে তিনি অবহেলিত। অন্যদিকে অন্য সরকারগুলোর আমলে নওগাঁ-৬ আসন রক্তাক্ত জনপদ হিসেবে পরিচিত ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এলাকায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। এর পেছনে কাজ করেছেন এমপি ইসরাফিল আলম।

বিএনপি : দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি নেতা-কর্মীরা এ জেলায় যেন ঝিমিয়ে পড়েছেন। রাজনীতির মাঠে নেই দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। প্রকাশ্যে বিভিন্ন উপজেলায় দুটি গ্রুপ দুই দিকে অবস্থান নেওয়ায় অস্বস্তিতে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। দলের বিভিন্ন কর্মসূচি পালনে দুটি গ্রুপ নিজেদের পছন্দের কর্মীদের নিয়ে মাঠে অবস্থান করলেও সাংগঠনিক চাঙ্গাভাব ফিরিয়ে আনতে পারছে না। তৃণমূল নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, জেলা বিএনপির প্রথম সারির নেতারা দুটি গ্রুপে বিভক্ত হওয়ার ফলে শক্ত অবস্থানে যেতে পারছেন না তারা। নেতাদের ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে মামলা-মোকদ্দমায় পড়লে পরবর্তী সময়ে তাদের আর খোঁজখবর রাখছেন না কেউ। ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তুলতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন নেতারা। ফলে জেলার কোথাও বিএনপির শক্ত অবস্থান নেই। একই সঙ্গে বিএনপির রাজনীতিতে রয়েছে বিভক্তি। মামলা ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জেলা বিএনপির রাজনীতি একরকম অস্তিত্ব সংকটে। জেলা ও উপজেলা কমিটি নিয়ে বিতর্ক, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দলীয় কর্মকান্ডে নিষ্ক্রিয়তার কারণে নেতৃত্বশূন্যতা দেখা দিয়েছে দলটিতে। এ অবস্থায় জেলা বিএনপির সাংগঠনিক কর্মকান্ড ও অস্তিত্ব নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন নেতা-কর্মীরা। জেলা বিএনপি চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। আহ্বায়ক হাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। নওগাঁ-১ আসনের সাবেক এমপি সালেক চৌধুরী ও জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি মোস্তাফিজুর রহমানের দুটি গ্রুপ পরস্পরের বিরুদ্ধে সক্রিয়। এ আসনের তিনটি উপজেলা সাপাহার, পোরশা ও নিয়ামতপুর। এর মধ্যে কোনো উপজেলায় বিএনপি পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেনি। ২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর নিয়ামতপুরে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি গঠন নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে স্থানীয় ইউপি সদস্য ওয়াহেদ আলী নিহত হন। এ ঘটনায় ডা. সালেক চৌধুরীর সমর্থক উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছাদরুল আমিন চৌধুরী বাদী হয়ে ৩২ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনকে আসামি করে থানায় মামলা করেন। আরও এক মুখ রয়েছেন পোরশা উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা। তিনিও এলাকায় আসেন ও কাজ করেন। নওগাঁ-২ আসনে যোগ্য নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে উৎকোচের বিনিময়ে নতুনদের স্থান দেওয়ার অভিযোগ করেছেন সাবেক এমপি সামসুজ্জোহা খান। তিনি বলেন, পত্নীতলা ও ধামইরহাট উপজেলায় টাকার বিনিময়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেছেন জেলা আহ্বায়ক হাফিজুর রহমান। ২৯ আগস্ট সংযোজন ও সংশোধন করে আহ্বায়ক হাফিজুর রহমান তার একক স্বাক্ষরে চূড়ান্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটি গঠন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে চলে নানা সমালোচনা। যোগ্য নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে উৎকোচের বিনিময়ে নতুনদের স্থান পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ তুলে ধরে নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করে থাকেন। জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মাস্টার হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব প্রচারণা চালানো হচ্ছে, সে বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আর অর্থ নিয়ে কমিটি দেওয়ার কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে আমার বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো অভিযোগ নেই।’ নওগাঁ-৩ বদলগাছী-মহাদেবপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনটিতে বিতর্কের শেষ নেই। এ আসনে রয়েছে বিএনপির তিনটি গ্রুপ। ফজলে হুদা বাবুল, সাবেক ডেপুটি স্পিকার প্রয়াত আখতার হামিদ সিদ্দিকীর ছেলে পারভেজ আরেফিন সিদ্দিকী জনি ও রবিউল আলম বুলেট এ তিন গ্রুপের নেতৃত্ব দেন। তবে দলের জন্য কাজ করতে মাঠে রয়েছেন ফজলে হুদা বাবুল। আর বাকি দুজন কোন্দল ও দ্বন্দ্বে রয়েছেন সব সময়।

সর্বশেষ খবর