মঙ্গলবার, ৩ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

ইসির ভুলে হয় সর্বনাশ

আইন অনুযায়ী কাগজপত্র দিয়েও মেলে না সংশোধনী

গোলাম রাব্বানী

ইসির ভুলে হয় সর্বনাশ

‘র’ আদ্যাক্ষরের এক ভোটার। বাড়ি সিরাজগঞ্জ। ২০১৮ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) হাতে পান তিনি। পরিচয়পত্র হাতে পেয়ে দেখেন জন্মসালসহ অনেক তথ্য ভুল। ভুল সংশোধন করতে গিয়ে পড়েন মহাবিপদে। ভোটার তথ্য ফরমে তাকে বিবাহিত দেখানো হয়েছে। এমনকি স্ত্রীর নামও দেওয়া হয়েছে। এই সংশোধনীর জন্য দলিল হিসেবে তার কাছে চাওয়া হয় তালাকনামা। তিনি এখনো বিয়ে করেননি, তালাকনামা পাবেন কই? ইসির মাঠ কর্মকর্তাদের এমন ভুলে সর্বনাশ হয়েছে এই ভোটারের। তিনি সরকারি চাকরির আবেদন করতে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন। আবেদনে বিবাহিত দেখালেও সমস্যা, আবার না দেখালেও সমস্যা। কেননা পরিচয়পত্র যাচাই করলে ইসির সার্ভারে বিবাহিতের তথ্য দেখাতে পারেন সংশ্লিষ্টরা। আবার চাকরির আবেদনেই বা তিনি কীভাবে বিবাহিত লিখবেন? এমন উভয় সংকটে পড়েছেন তিনি। অপরজন জুলকার নাইন। গাইবান্ধার ভোটার। জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যে তার চেয়ে তার মায়ের দুই বছর কম দেখানো হয়েছে। ইসির এনআইডি উইংয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনী করতে আসা ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে এমন চাঞ্চল্যকর ভুলের তথ্য পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সংশোধনীর জন্য প্রথমে উপজেলা নির্বাচন অফিসের একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রয়োজন হয়। আর তদন্ত প্রতিবেদন টাকা ছাড়া পাওয়া যায় না। প্রথমত, উপজেলা নির্বাচন অফিসের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর, পিয়নদের টাকা না দিয়ে সংশোধনীর আবেদন জমা দিলে সেই আবেদন মাসের পর মাস উপজেলা অফিসে পড়ে থাকে। টাকা দিলেই আবেদন সার্ভারে আপলোড করা হয়। এরপর তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য দিতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। জন্মসাল সংশোধনীর জন্য প্রতি বছরের জন্য দিতে হয় ১০ হাজার টাকা। কেউ যদি এনআইডি কার্ডে ১০ বছর বয়স সংশোধন করতে চান, তবে তাকে ১ লাখ টাকার বেশি দিতে হয়। এ টাকার ভাগ উপজেলা-জেলা এবং ইসির ঢাকা অফিস পর্যন্ত দিতে হয় বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এদিকে গতকাল ছিল জাতীয় ভোটার দিবস। ২০১৯ সালে এই দিবস ১ মার্চ পালন করা হলেও এবারই প্রথম ২ মার্চ পালন করা হলো। পরবর্তী বছরগুলোতে ২ মার্চ দেশব্যাপী জাতীয় ভোটার দিবস পালন করা হবে। গতকাল ভোটার দিবসের দিনে নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (ইটিআই) ভবনের নিচে বেশ কিছু ভোটারের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। জানতে চাওয়া হয় ভোটার দিবসে ভোটারদের চাওয়া-পাওয়ার কথা। এ সময় ভোটাররা নানা অভিযোগের কথা তুলে ধরেন। অনেকে বলেন, ভোটার দিবসের দিনও ইসির সার্ভার ঠিকভাবে কাজ করেনি। অনেকে হারানো এনআইডি, সংশোধনীর তথ্য জানতে এসেও কোনো তথ্য পাননি। ভোটারদের প্রশ্ন, ভোটার দিবসের দিনেও ইসির সার্ভার কাজ না করলে কীভাবে হবে! এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনআইডি উইংয়ের পরিচালক (অপারেশন) আবদুল বাতেন বলেন, ‘সার্ভারের বিষয় আমি বলতে পারব না।’ ভোটারের হয়রানির বিষয়ে গতকাল কথা হয় ইসির এক কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি জাতীয় পরিচয়পত্রে বিভিন্ন ভুলের ভয়াবহ তথ্য দেন। জানান দুই সহোদর ভোটারের ভোগান্তির কথা। এই কর্মকর্তা বলেন, বরিশালের গৌরনদী উপজেলার দুই ভোটার এসেছিলেন তার কাছে সংশোধনীর বিষয়ে। তারা দুই ভাই ভোটার হয়েছেন একই সঙ্গে। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্রে শুধু দুই ভাইয়ের ছবিই আলাদা। নাম, জন্মসাল, জন্মতারিখ সবই এক।

‘র’ আদ্যাক্ষরের এক নারী ভোটার। তার জাতীয় পরিচয়পত্রে নামটাই শুধু ঠিক আছে। মায়ের নামের স্থানে দেওয়া হয়েছে বাবার নাম। বাবার নামের স্থানে স্বামীর নাম। এই ভুল কার্ড নিয়ে তিনি কোনো কাজ করতে পারছেন না।

‘আ’ আদ্যাক্ষরের চট্টগ্রাম সিটির এক ভোটার। থাকেন ঢাকায়। তার জাতীয় পরিচয়পত্রে নিজের নামের কিছু অংশ, জন্মতারিখ-সাল ও মায়ের নাম পুরোপুরি ভুল দেওয়া হয়েছে। যদিও তার অন্য ভাই-বোনের আইডি কার্ডে মায়ের সঠিক নাম দেওয়া আছে। এখন তিনি কীভাবে প্রমাণ করবেন জাতীয় পরিচয়পত্রে তার মায়ের নাম ভুল? এই সংশোধনীর (প্রমাণের) দলিল হিসেবে ভাই-বোনের পরিচয়পত্র, ওয়ারিশনামা, বিয়ের কাবিননামা দিয়েও ইসির কর্মকর্তাদের বিশ্বাস করাতে পারছেন না যে তার মায়ের নাম পুরোপুরি ভুল। তিনি সব কাগজপত্র নিয়ে ইসি অফিসে সংশোধনীর জন্য যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু ইসির কর্মকর্তাদের প্রশ্ন, ‘অন্য ভাই-বোন যে আপনার আপন ভাই-বোন, অন্যদের মা যে আপনারও মা, এর প্রমাণ কী?’ এই ভোটারের প্রশ্ন, ইসি আইন করেছে, গেজেট করেছে কোন সংশোধনীর জন্য কোন কোন কাগজ দিতে হবে। কিন্তু সব কাগজপত্র দেওয়ার পর কেন সংশোধনের আবেদনটাও নেওয়া হচ্ছে না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর