বৃহস্পতিবার, ৫ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

ইজি মানি

মির্জা মেহেদী তমাল

ইজি মানি

ধনাঢ্য ব্যবসায়ী শফিকুর রহমান (ছদ্মনাম)। একদিন সন্ধ্যায় তার মোবাইলে কল আসে। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে একজন বলে উঠলেন, এটা কি শফিক সাহেবের নম্বর? আমি থানা থেকে বলছি। আপনার ছেলের নাম কি রাফি? সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তার মুখে নিজের ছেলের নাম শুনে একটু বিরক্ত হন শফিকুর রহমান। বলেন, হ্যাঁ, আমার ছেলে রাফি। কেন, কী ব্যাপার? আপনার ছেলে ছিনতাই করতে যেয়ে গ্রেফতার হয়েছে। অভিযোগকারী নিজে থানায় আছেন। আপনার ছেলেও আমাদের হেফাজতে। এ কথা শুনে শফিকুর রহমান নিজের কণ্ঠ একটু নিচু করে বলেন, কী বলছেন এসব। আমার ছেলে ছিনতাই করতে যাবে কেন? ঠিক আছে আমি আসছি। এ কথা বলেই গাড়ি নিয়ে থানায় যান শফিকুর। ঘটনা সত্যি, তার ছেলে একজন পথচারীর ব্যাগ ধরে টেনে নিয়ে পালাতে যাচ্ছিল। শফিকুর তার ছেলের এমন কান্ড শুনে লজ্জা পান। যার ব্যাগ টানাহিঁচড়া করছিলেন, তাকে হাতে পায়ে ধরে বিষয়টা মীমাংসা করেন। সে যাত্রায় জেল খানায় যাওয়া থেকে রক্ষা পায় রাফি। এটি রাজধানী ঢাকার ঘটনা। ওরা সাতজন। প্রত্যেকেই ধনীর দুলাল। তাদের আছে দামি মোটরসাইকেল। রাত নামলেই নগরীর রাস্তা দাপিয়ে বেড়ায়। ওতপেতে থাকে ‘শিকারের’ অপেক্ষায়। শিকার মিলে গেলেই ছোঁ মেরে সব নিয়ে যায়। এমনকি দিনের বেলায়ও চলে তাদের দৌরাত্ম্য। রাজশাহী নগরীর চিহ্নিত ছিনতাইকারী। নাম মাহি, মুন, শাকিল, জয়, কাফি, ইস্তি ও প্রান্ত। ফেসবুকে বেশ, কয়েকটি গ্রুপ আছে তাদের। বিভিন্ন নামে। ফালতু গ্রুপ নামের গ্রুপটি নাম করেছিল সে সময়ে। অভিভাবকদের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাতজনের মধ্যে কারও বাবা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কেউ রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা, কেউ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী, কেউ বড় ব্যবসায়ী অথবা সরকারি বড় কর্মকর্তা। অথচ তাদের ছেলেরাই শহরের পুলিশের তালিকাভুক্ত ছিনতাইকারী। পুলিশ সূত্র জানায়, রাজশাহী মহানগরীতে ঘটে যাওয়া একের পর এক ছিনতাইয়ের মূল হোতাদের ধরতে পুলিশের অভিযানের মুখে বের হয়ে আসে এসব তথ্য। পুলিশ নগরীতে ঘটে যাওয়া ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে অন্তত ৩১ জনের নাম তালিকাভুক্ত করেছে। তাদের মধ্যে উপরের দিকে রয়েছে ওই সাতজনের নাম। তাদের একেকজনের বিরুদ্ধে রয়েছে অন্তত দুটি করে ছিনতাইয়ের মামলা। এ পর্যন্ত ধরা পড়েছে চারজন। এ ছাড়া অন্য ছিনতাইকারীদের মধ্যে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছে আরও অন্তত ১০ জন। আর বাকিরা এখনো দাবড়ে বেড়াচ্ছে গোটা মহানগর। কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘ছিনতাইকারীদের গ্রেফতারের পর বড় ধরনের তদবির আসে। ফলে ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে অনেক সময় পুলিশ যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এতে নগরীতে ছিনতাইয়ের পরিমাণ রোধ করা যাচ্ছে না।’ রাজধানী ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী কিংবা বাণিজ্যিক শহর চট্টগ্রামের মতো কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার প্রতিটি জনপদে বর্তমান সময়ে অনেকটা ফিল্মিস্টাইলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে উঠতি বয়সের বিপদগামী কিশোররা। দিবারাত্রি তারা মাদক বেচাকেনা, সেবন, ডিজে পার্টি ও চুরি-ছিনতাই নিয়ে ব্যস্ত থাকে এই গ্যাংয়ের কিশোররা। এদের অধিকাংশের বাবা-মায়েরা সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি। তাদের সন্তানদের খবর জানতে পেরে তারা গভীর কষ্ট পান। যেটা বিশ্বাস করা তাদের জন্য খুবই কষ্টদায়ক। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আজকের যুগে এমন একটি বিষয়ে আলোকপাত হয়েছে, যে বিষয় নিয়ে এখন প্রত্যেকের ভাবা উচিত। আজকের যুব বা কিশোর সম্প্রদায় ‘ইজি মানি’ অর্থাৎ কোনো পরিশ্রম না করে শুধু টাকা উপার্জনের জন্যে অপরাধের সাহায্য নিচ্ছে। আর এই টাকাটা ওরা তাদের নেশা ও অন্যান্য খারাপ কাজে ব্যবহার করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল ইসলাম বলেন, যুব সমাজের অনেক আকাক্সক্ষা রয়েছে। খুব তারাতারি সব কিছু পাওয়ার আশা আছে তাদের। আর ওই আশা পূরণের জন্য বাড়ি থেকে পাওয়া টাকায় পূরণ হচ্ছে না। তখন তারা ভয়ঙ্কর সব পথের সাহায্য নিচ্ছে। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ব্যাপারে এতটাই অন্ধ থাকে যে, তারা বাইরে কী করছে না করছে, তার কোনো খেয়াল তারা রাখছে না। যে কারণে, ধ্বংসের পথে যাচ্ছে যুব সম্প্রদায়। জড়িয়ে পড়ছে নানা ভয়ঙ্কর সব অপরাধে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর