শুক্রবার, ১৩ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

ডুবোচর আবর্জনায় জীর্ণশীর্ণ তিতাস

নদীর কান্না

মোশাররফ হোসেন বেলাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

ডুবোচর আবর্জনায় জীর্ণশীর্ণ তিতাস

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বেষ্টিত হয়ে আছে তিতাস নদী। এ নদী ছাড়া জেলার অস্তিত্ব চিন্তাও করা যায় না। তিতাসের নামেই দেশের অন্যতম গ্যাসকূপ তিতাস গ্যাস। তিতাসের সেই জৌলুস আর নেই। শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি না থাকায় আগের মতো জেলেদের মাছ ধরতেও দেখা যায় না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্য একসময়ের খরস্রোতা তিতাস নদী। এ নদীকে কেন্দ্র করে শহরের অন্যতম বৃহৎ হাট আনন্দবাজার ও জগৎবাজার গড়ে উঠেছিল। ডুবোচর জেগে ওঠা, দখল আর আবর্জনায় নাব্যতা হারিয়ে তিতাস এখন জীর্ণশীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে। পলি জমে গত দুই দশকে তিতাসের তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, একসময় লঞ্চের শব্দ আর বড় বড় পালতোলা নৌকার মাঝিমাল্লাদের ভাটিয়ালি গানের সুরে ঘুম ভাঙত তিতাস পাড়ের অনেকের। কিন্তু তিন দশকের ব্যবধানে এ নদীর তলদেশের ডুবোচর জেগে উঠেছে। তিতাসের তীরে বিভিন্ন অংশে হয়েছে নির্দয় দখল আর দূষণ। এ কারণে খরস্রোতা ভরা নদীটি এখন মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। সূত্রমতে, মেঘনা থেকে বোমালিয়া খাল দিয়ে এসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল-নাসিরনগর ব্রিজের নিচ দিয়ে ভাটির দিকে যে পানি প্রবাহিত হচ্ছে, তা থেকে তিতাস নদীর সৃষ্টি। পরে তা জেলার নবীনগর উপজেলার চিত্রি গ্রামে গিয়ে মেঘনা নদীতে গিয়ে মিলেছে। দেশের অন্যান্য নদীর চেয়ে তিতাস বেশি আঁকাবাঁকা। সর্পিল তিতাসের প্রায় ৪০ কিলোমিটার ভরে গেছে। নদীর বুকে এখন আর মাঝিমাল্লাকে পালতোলা নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে দেখা যায় না। বর্ষায়ও চোখে পড়ে না তিতাসের রুদ্রমূর্তি। পাড় দখল করে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। কোথাও কোথাও চোখে পড়ে জেগে ওঠা চর। বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় বিভিন্ন নৌ-রুট। শুকনো স্থানে পড়ে থাকা নৌকাগুলো দেখে মনে দাগ লাগে। আখাউড়ার দিকে ধাবিত তিতাস নদী পুরোপুরি মরে গেছে। একসময়কার কালিদাস সায়র (সাগর) নামে পরিচিত তিতাস নদী ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাকে কল্পনাও করা যেত না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, সদর, বিজয়নগর, নাসিরনগর ও নবীনগর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে তিতাসের কূল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বড় বড় হাটবাজার। বাজারের ব্যবসায়ীরা দোকানের পণ্যসামগ্রী নৌকা দিয়েই আনা-নেওয়া করতেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার আনন্দবাজার, টানবাজার, গোকর্ণঘাট, বিজয়নগরের চান্দুরা বাজার, নাসিরনগরের হরিপুর, সরাইলের শাহবাজপুর, আখাউড়ার বড় বাজার ও নবীনগরের বড়াইল, গোসাইপুর এলাকায় গড়ে উঠেছে বড় বড় বাজার। ঘাটগুলোতে ভিড় করত মালবাহী বড় বড় নৌকা। নদী ঘিরে আখাউড়া বড় বাজার, বিজয়নগরের চান্দুরা, নাসিরনগরের হরিপুরে গড়ে উঠেছিল বিশাল পাটের বাজার। ছিল ডাউস আকৃতির গুদাম। নদী ভরাটে জেলেদের ভাগ্যে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। কমপক্ষে অর্ধলক্ষ জেলে একসময় নৌকা ও ডিঙি দিয়ে সারা বছরই মাছ ধরতেন। জীবিকার একমাত্র অবলম্বন ছিল মাছধরা। এখন অধিকাংশ জেলে পরিবারেই পেশা পরিবর্তন হয়েছে। খনন না করায় স্রোতস্বিনী তিতাস নাব্যতা হারিয়েছে। অন্যদিকে বছরের পর বছর ধরে পাহাড়ি ঢলে নদী ভরাট হচ্ছে। ত্রিপুরার পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে আসা পলি তিতাসের নাব্যতাকে থামিয়ে দিচ্ছে। দখলবাজদের কবলে পড়ে স্বাভাবিক প্রবাহ হচ্ছে বাধাগ্রস্ত। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শাহবাজপুর, মজলিশপুর, বাকাইল, শহরের পূর্ব মেড্ডা, পাইকপাড়া, আনন্দবাজার, টানবাজার ও শিমরাইলকান্দি এলাকায় পাড় ভরাট করে গড়ে উঠেছে স্থায়ী অবৈধ স্থাপনা। নাব্যতা হারানোর ফলে কৃষিজমিতে সেচকাজে বিঘ্ন ঘটছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী রঞ্জন কুমার দাস জানান, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে তিতাস নদী খননের সিদ্ধান্ত হয়। তিতাসের ১৩০ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায়  ১১৯ কিলোমিটার খননের জন্য ১৫৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অত্যাধুনিক ড্রেজার মেশিন দিয়ে নদীর ৭০ কিলোমিটার খননকাজ সম্পন্ন হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে খননকাজ সম্পন্ন হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর