শনিবার, ১৪ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

ক্রাইম প্যাট্রোল কাহিনি

মির্জা মেহেদী তমাল

ক্রাইম প্যাট্রোল কাহিনি

ইয়াসির আরাফাত। ৫ম শ্রেণির ছাত্র। শিশুটির এক জোড়া রোলার স্কেটস ছিল। তার এক বন্ধু সেটি কিনতে চায়, কিন্তু টাকা পরে দেবে। আরাফাত রাজি হয়ে বন্ধুকে স্কেটস জোড়া দিয়ে দেয়। বন্ধু যখন টাকা দিতে পারছিল না, তখন আরাফাত টাকার বদলে বন্ধুর কবুতর জোড়া চায়। কিন্তু বন্ধু কবুতরও দিতে চায় না। আরাফাত মন খারাপ করে। কিন্তু তার ওই বন্ধুও ভাবতে থাকে, কী করবে। টাকা দেবে কোথা থেকে? সে তার অন্য দুই বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করে এ নিয়ে। সোজা একটি পথ তারা খুঁজে বের করে। আরাফাতকে তারা মেরে ফেলবে।

পরিকল্পনামাফিক তিন শিশু মিলে আরেক শিশু আরাফাতকে একটি আখ খেতে নিয়ে বেদম মারধর করে। মরে গেছে ভেবে তারা ফেলে রেখে আসে আখ খেতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আরাফাতকে মুমূর্ষু অবস্থায়  উদ্ধার করে পুলিশ। শিশুদের এই খুনোখুনির ঘটনাটি ভারতীয় সিরিজ ‘ক্রাইম প্যাট্রলের কাহিনির’ মতো শোনালেও এটি সত্য ঘটনা বাংলাদেশের। তবে শিশুরা খুনের পুরো পরিকল্পনা এঁটেঁছিল ভারতীয় সিরিজ ‘ক্রাইম প্যাট্রোল’ দেখেই। গত ডিসেম্বরে পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার ঘটনা এটি। আরাফাত সেই বছর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা দিয়েছিল। তিন বন্ধুর মধ্যে দুজন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র, আরেকজন সপ্তম শ্রেণির। তাদের সবার বাড়ি ঈশ্বরদী উপজেলায়। অভিযুক্ত তিন শিশুকে আটক করেছে পুলিশ। তাদের সঙ্গে নিয়েই আখ খেতের ভিতর থেকে আরাফাতকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের এক সকালে বাড়ি থেকে বের হয় আরাফাত। দুপুরে বাড়ি ফেরার কথা থাকলেও ফেরেনি সে। আরাফাতের পরিবার থানায় খবর দিলে পুলিশ আরাফাতের কাছের এক বন্ধুকে ডেকে আনে। জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, দুপুর ১২টার দিকে আরাফাতকে একটি ছেলের সাইকেলে করে যেতে দেখেছে। আরও দুই শিশুও একই কথা জানায়। এভাবে প্রায় দেড় ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর একপর্যায়ে একটি শিশু বলে, ‘স্যার আমার কিছু হবে না তো?’ পরে পুলিশের আশ্বাস পেয়ে সে বলে, ‘আরাফাতের লাশ কোথায় আছে আমি জানি, কিন্তু আমি কাছে যেতে পারব না।’ এরপর রাত ১১টায় ওই শিশুর দেখানো জায়গায় পৌঁছায় পুলিশ। জায়গাটি ঈশ্বরদী থানা থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে। যাওয়ার পথে এক শিশু বলে, ‘স্যার আমরা আখ খেতের ভিতরে আরাফাতকে মেরে ফেলেছি। সে ওখানে মরে পড়ে আছে।’ তাদের কথামতো আখ খেতের ভিতরে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা অবস্থায় আরাফাতকে পাওয়া যায়। মাথায় অনেক আঘাতের চিহ্ন, বাঁ কানের অনেকটা অংশ কাটা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। মারধরের পর দীর্ঘ ১৩ ঘণ্টা ধরে রক্তক্ষরণ হয়। অস্ফুট স্বরে আরাফাত তখন বলছিল, ‘আপনারা কারা? আমাকে একটা বালিশ দিন আমি একটু ঘুমাবো। আমার আব্বু আম্মু কোথায়?’ এত রক্তক্ষরণের পরেও শিশুটি বেঁচে ছিল। পুলিশ জানায়, তিন বন্ধু আরাফাতকে এক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। এরপর তারা আখ খেতে গিয়ে একসঙ্গে আখ খায়। একপর্যায়ে এক বন্ধু আরাফাতকে বলে, আখের গোড়ার দিকে যে নতুন কুশি বের হয়েছে সেগুলো ভেঙে নিয়ে বাড়িতে লাগালে আখ গাছ হবে। বন্ধুদের কথামতো এই কাজ করার সময় পেছন থেকে একজন আরাফাতের মাথায় লোহার রড দিয়ে আঘাত করে। মারধরের একপর্যায়ে আরাফাত মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ফেরার পথে রডটি একটি পুকুরে ফেলে দেয় তারা। পুলিশ রক্তমাখা সেই রডটি উদ্ধার করে। পুলিশ জানায়, আটক তিন বন্ধুই জিজ্ঞাসাবাদের সময় স্বীকার করেছে, কীভাবে তারা ক্রাইম প্যাট্রল দেখার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আরাফাতকে হত্যার চেষ্টা করেছে। তারা আগে থেকেই ঘটনাস্থলে ব্যাগে করে লোহার রড রেখে এসেছিল। তিনজনকেই যশোর শিশু সংশোধনাগার কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।

 শিশু তিনটি ভারতীয় টেলিভিশনে ‘ক্রাইম প্যাট্রল’ দেখে হত্যার নকশা করেছিল। ভারতীয় এই টেলিভিশন শো-তে পুলিশের কাছে মীমাংসিত কোনো ভয়ঙ্কর অপরাধের কাহিনি সিনেমাটিক কায়দায় দেখানো হয়। ‘সত্য’ ঘটনা অবলম্বনে দেখানো সেসব গল্প দর্শকদের মনে রোমাঞ্চ জাগায়, ভয় জাগায়, অপরাধীর প্রতি ঘৃণা জাগায়। আবার অনেকে সেখান থেকে শেখে অপরাধের নিখুঁত কায়দা-কৌশল। শিশুরা না হয় অপরিণামদর্শী, কিন্তু সাবালক মানুষও কি একই পথে যাচ্ছে না? অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুরা মায়ের পেটে জন্মায় ঠিকই, কিন্তু তাদের মনমানসিকতা গড়ে দেয় অন্য কেউ। টেলিভিশন, ইউটিউব, রিয়েলিটি শো, বিজ্ঞাপন। আর এসব বিনোদন এমনই শিক্ষণীয় যে, শিশুদের কেউ কেউ খুনের শিক্ষাটাই পায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক (সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক) তৌহিদুল হক বলেন, এ  থেকে মুক্তি পেতে হলে পরিবার, সমাজ যে যেখানে আমরা দায়িত্বশীল আছি তাদের সবাইকে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে। সবাইকে সবার  খোঁজখবর সঠিকভাবে রাখতে হবে, যাতে কেউ  চোখের আড়ালে কোনো অপরাধে জড়িয়ে পড়তে না পারে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর