শুক্রবার, ২০ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুকে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম

ড. কামাল হোসেন

বঙ্গবন্ধুকে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম

১৯৭১ সালের ২৩, ২৪ মার্চেই আমরা আশঙ্কা করছিলাম যে, খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য এসে চট্টগ্রামে নামছিল। বুঝলাম তারা আক্রমণ করার জন্য শক্তি বাড়াচ্ছে। ২৫ মার্চ সেটা দৃশ্যমান হলো। পাক হানাদাররা নগ্নভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরীহ বাঙালির ওপর।

ওইদিন (২৫ মার্চ) রাত ৯টার দিকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গেলাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। উদ্দেশ্য বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে তাজউদ্দীন ভাইকে নিয়ে পুরনো ঢাকার কোথাও আশ্রয় নেব। আমাদের দেখেই বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তোমরা এখনো যাওনি?’ আমাদের ওপর নির্দেশনা ছিল ঢাকা ছেড়ে জেলায় জেলায় গিয়ে জনগণকে নিয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ শুরু করা। বললাম, অনেক মানুষ, সাংবাদিক আমাদের কাছে এসে তাদের করণীয় জানতে চাইছে। এ জন্য একটু দেরি হয়েছে, এখনি বেরিয়ে পড়ছি। আমরা আপনাকে নিয়ে চিন্তিত। বঙ্গবন্ধু বললেন, আল্লাহ ভরসা। তোমরা যাও। আমাদের লোকজন ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করবে। বিজয় আমাদের অনিবার্য।

ওখান থেকে গেলাম তাজউদ্দীন ভাইয়ের বাসায়। এর মধ্যে কুমিল্লার সংসদ সদস্য মোজাফফর সাহেব এসে বললেন, নিউমার্কেটে ইপিআর পজিশন নিয়ে নিয়েছে। পুরনো শহরে যেতে ওখানে বাধার মুখে পড়বেন। আমরা ভাবলাম, রাতটা যে যার মতো আশপাশে পরিচিতদের বাসায় থেকে সকালে একত্রিত হয়ে পুরনো শহরে যাব। আমি কাছে এক ভাগ্নের বাসায় নেমে গেলাম। তাজউদ্দীন ভাইরা চলে গেলেন। পরের দিন আমাদেরকে তুলে নেওয়ার কথা। সেটা আর হয়নি। নয় মাস পর জানতে পারি তারা ওই বাসা খুঁজে পাননি। কোনো এক ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন আমাকে মেসেজ দিতে। সেও খুঁজে পায়নি। আমি এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি বদলাতে থাকলাম। দুয়েকদিন পরেই লালমাটিয়া থেকে আমাকে আটক করল আর্মিরা। ভেবেছিলাম আর বেঁচে ফিরব না। আমাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গেল। কিছুক্ষণ এক জায়গায় বসিয়ে পরে নিয়ে গেল জিওসির বাসায়। আমাকে বলল, তোমার নেতা (বঙ্গবন্ধু) তো এখানেই এক রাত কাটিয়েছে। এরপর পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তখনই জানতে পারি বঙ্গবন্ধুকে ওরা আটক করেছে। পরের দিন সকালে আমাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে গেল। তখন ভারতের ওপর দিয়ে ফ্লাইট বন্ধ। শ্রীলঙ্কার ওপর দিয়ে ঘুরে করাচিতে নামল প্লেন। সেখান থেকে আরেক প্লেন। সেটা গিয়ে নামল রাওয়ালপিন্ডি। ওখান থেকে গাড়িতে করে আমাকে নিয়ে গেল হরিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে। সেই যে ঢুকলাম জেলে, বেরিয়েছি ২৮ ডিসেম্বর। সেদিন একজন এসে আমাকে বলল, ‘তোমার মালপত্র গুছিয়ে নাও।’ বললাম, কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? বলল, চিন্তা করো না, ইউ উইল লাইক ইট (তোমার পছন্দ হবে)। ভাবলাম, রাওয়ালপিন্ডি নিচ্ছে। পরে দেখলাম লাহোরের দিকে যাচ্ছে। যতবার জিজ্ঞাসা করি কোথায় নিচ্ছ, ওরা বলে ‘ইউ উইল লাইক ইট’। গাড়িটা একটা বাংলোয় গিয়ে দাঁড়াল। এক অফিসার এসে বলল, এক নম্বর রুমে ঢোকো। ঢুকেই দেখি বঙ্গবন্ধু দাঁড়ানো। আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। ভয় করছিল যে, হয়তো উনাকেও মেরে ফেলবে, আমাদের তো কথাই নেই। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘দেরি হলো কেন? আমি ভুট্টোকে তোমার কথা বলেছিলাম।’ এরপর বঙ্গবন্ধু তাকে গ্রেফতার ও তথাকথিত বিচারের অভিজ্ঞতা বলতে লাগলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমাকে যখন বলল আপনি কাকে আইনজীবী দেবেন? আমি তোমার নাম বলেছিলাম। ওরা বলাবলি করছিল- এটা তো সম্ভব না। আমার মধ্যে খটকা লাগল। পরে বুঝলাম হয়তো তুমি এখানে বন্দী। পরে তারা তাদের এক আইনজীবী দেয় আমাকে। আমি তো বুঝতেই পেরেছিলাম যে, তারা আমাকে মৃত্যুদন্ড দেবে। বিচার শেষ করে রায় ঘোষণা না করে আমাকে আবার জেলে পাঠায়। ২৬ ডিসেম্বর ভুট্টো আসে আমার সঙ্গে দেখা করতে। এসেই নরমভাবে বলে, ‘আপনিই তো পাকিস্তান বানিয়েছেন। আমি তখন ছোট ছিলাম। ইত্যাদি।’ আমি বললাম, এসব কথা বাদ দাও। আমাকে যত তাড়াতাড়ি পার বাংলাদেশে পাঠাও। সেখানে গিয়ে তোমার এসব ব্যাপারে বিবেচনা করে উত্তর দেব। বের হওয়ার সময় ভুট্টোকে বলেছিলাম, দেখো, কামাল হোসেনও বোধহয় এখানে বন্দী। সেটা হলে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। সে কথা রেখেছে। তোমাকে পাঠিয়েছে।’

লেখক : গণফোরাম সভাপতি ও সংবিধান প্রণেতা। অনুলেখক : শামীম আহমেদ।

সর্বশেষ খবর