রবিবার, ২২ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

মামলা নিতে অনীহা পুলিশের

রাজনৈতিক নেতা জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় মাস্তান ও খোদ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তদবিরে থেমে যায় ধর্ষণ মামলার তদন্ত

মাহবুব মমতাজী

ধর্ষক, চোর ও ছিনতাইকারীদের উপদ্রব বেড়েই চলেছে। প্রায় প্রতিদিনই চুরি, ছিনতাই আর ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। তবে বেশির ভাগ ঘটনায় মামলা হচ্ছে না। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, চুরি আর ছিনতাইয়ের অভিযোগ করতে গিয়ে উল্টো অভিযোগকারীকেই হেনস্তা হতে হয়, এমন ঘটনা এখন সারা দেশেই। ধর্ষণের মামলা করতে গিয়ে অধিকাংশ নারী ও শিশু থানা পুলিশের হেনস্তার শিকার হয়। আর চুরি ও ছিনতাইয়ের শিকার ব্যক্তিকে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করাতে বাধ্য করা হয়। পরে মামলা রেকর্ড হলেও অভিযোগকারীকে গুনতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। আসামি ধরার ক্ষেত্রেও পুুলিশের অনীহা দেখা যায়। তবে আসামি ধরতে না পারার পেছনে পুলিশের পক্ষ থেকে নানা ধরনের যুক্তি পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় মাস্তান ও খোদ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তদবিরে থেমে যায় ধর্ষণ মামলার তদন্ত। কয়েকটি ঘটনায় দেখা যায়, অফিস শেষে বাসায় ফেরার পথে অপহরণের পর ধর্ষণের শিকার হন এক নারী। কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার একটি এনজিওতে কাজ করেন তিনি। তার স্বামী প্রবাসী। মিনহাজুল হায়াত (৩৫) নামে এক ব্যক্তি তাকে নাথের পেটুয়া বাজার থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করেন বলে তার অভিযোগ। ঘটনার পরই অসুস্থ অবস্থায় মনোহরগঞ্জ থানায় গিয়ে অভিযোগ করেন তিনি। কিন্তু পুলিশ মামলা না নিয়ে তাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়। পরে ওই নারীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার-ওসিসিতে ভর্তি করা হয়। স্বজনদের অভিযোগ, ধর্ষণের অভিযোগের বিষয়ে ওসিসিতে দায়িত্বরত পুলিশ সাব ইন্সপেক্টর নাসরিন মনোহরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) ফোন দিয়ে মামলা নেওয়ার সুপারিশ করেন। এরপর স্বজনরা থানায় গেলেও কোনো মামলা নেয়নি পুলিশ। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ের সামনে থেকে বাসে ওঠেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের উপপরিচালক (অর্থ) জুলফিকার আলী তালুকদার। বাসটি সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে  মতিঝিল শাপলা চত্বরে গিয়ে যানজটে পড়ে। মাঝখানের    সিটে বসে ছিলেন তিনি। জানালা খোলা ছিল। হাতে তখন মোবাইল ফোন। সড়ক বিভাজকের ওপর থেকে এক ছিনতাইকারী জানালায় থাবা      মেরে তার  মোবাইল ফোন নিয়ে যায়। তিনি  মতিঝিল থানায় মামলা করতে যান। থানার ডিউটি অফিসার তাকে ছিনতাইয়ের মামলা করতে নিরুৎসাহিত করে জিডি করতে বলেন। তিনি ‘মোবাইল ফোন হারিয়ে গেছে’ মর্মে জিডি করেন। জিডি নম্বর ১৬৬০। ঢামেক ওসিসির তথ্যানুযায়ী, সম্প্রতি নারী নির্যাতন কমছে। কিন্তু ধর্ষণের শিকার বেড়েই চলেছে। এ বছর জানুয়ারিতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আটজন। দগ্ধ হয়েছেন একজন। আর ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৪ জন। ফেব্রুয়ারিতে নয়জন শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার ৮৯ জন। চলতি মাসের ১২ তারিখ পর্যন্ত শারীরিক নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ২৯ জন। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ঢাকায় জানুয়ারিতে ছিনতাই হয়েছে মাত্র পাঁচটি। আর ফেব্রুয়ারিতে নয়টি। অভিযোগ রয়েছে, অপরাধপ্রবণতা কম দেখাতে ছিনতাইয়ের ঘটনা আড়াল করে ‘হারিয়ে গেছে’ মর্মে জিডি করতে বাধ্য করে থানা পুলিশ। গত ৮ মার্চ রাজধানীতে যৌন হয়রানির শিকার হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী। এ ঘটনায় ওইদিন রাত ১১টায় তিনি শেরেবাংলানগর থানায় মামলা করতে গেলে তা নিতে অস্বীকৃতি জানায় পুলিশ। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপে দুই দিন পর মামলা নেয় পুলিশ। ১০ মার্চ রাতে পশ্চিম মণিপুর থেকে অভিযুক্ত তারেক নামে এক যুবকে আটক করা হয়। গত ৭ মার্চ অশ্লীল ছবি ছড়ানোর অভিযোগে পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা করতে মিরপুর থানায় যান কর্মজীবী এক নারী। অভিযুক্ত ব্যক্তি সরকারি একজন কর্মকর্তা হওয়ায় মামলা নিতে রাজি হয়নি থানা পুলিশ। ভুক্তভোগীর স্বজনরা ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের কাছে বিষয়টি জানান। পুলিশ কমিশনারের হস্তক্ষেপে ১১ মার্চ মামলা নিতে বাধ্য হয় পুলিশ। ১৩ মার্চ রাতে ওই আসামিকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পশ্চিম বিভাগ। কুমিল্লার মনোহরগঞ্জে ধর্ষণের শিকার এনজিও কর্মীর মামলা না নেওয়ার বিষয়ে থানার ওসি মেসবাহ উদ্দিন ভূঁইয়া ১৭ মার্চ বলেন, ‘আমরা কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। ওই নারী ঢাকায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসা শেষে থানায় এলে মামলা নেওয়া হবে।’ পর্নোগ্রাফি আইনে কর্মজীবী নারীর মামলা গ্রহণ না করার বিষয়ে মিরপুর থানার ওসি মোস্তাজিরুর রহমান বলেন, ‘অভিযোগটি ভুল। যে কেউ অভিযোগ নিয়ে এলে আমরা মামলা নিই।’ গত বছরের মার্চে পুলিশ স্টাফ কলেজের ‘কনভিকশন অব রেপ কেসেস : আ স্টাডি অন মেট্রোপলিটান সিটিজ অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০০৩-২০১৭ সালে ছয়টি মহানগর এলাকার মধ্যে ঢাকায় বিচারের হার ছিল সবচেয়ে কম। এই সময়ে ১ দশমিক ৬ শতাংশ মামলার বিচার হয়েছে ঢাকায়। নারী-শিশুদের বড় একটি অংশ বিচারের প্রাথমিক পর্যায় পেরোতেই হিমশিম খায়। ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুদের মধ্যে যারা থানায় গিয়ে হেনস্তার শিকার হয়, তাদের অর্ধেক বলেছে, পুলিশ মামলা রেকর্ড করলেও পাত্তা দেয়নি, মামলা করতে নিরুৎসাহিত করেছে, ধর্ষণের শিকার হওয়ায় থানায় পুলিশ কটূক্তি করেছে কিংবা মামলা না করার জন্য থানায় বসেই হুমকি দিয়েছে। কেউ কেউ একের বেশি অভিযোগ করেছে। গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরিতে দেশের ছয় মহানগরের ২২টি থানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এসব থানায় ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে হওয়া ৫৭৫টি মামলার এজাহার, ধর্ষণের শিকার ১৭৫ নারী ও শিশু এবং ১৯১ জন তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করা হয়। পুলিশ তদন্তে দেখেছে, ধর্ষণের শিকার দুই তৃতীয়াংশই শিশু। ধর্ষকদের সবচেয়ে বড় অংশ প্রতিবেশী। সাম্প্রতিক সময়ে সহপাঠী বা ফেসবুক বন্ধুদের বিরুদ্ধেও ধর্ষণের মামলা হয়েছে।

ওই গবেষণায় কামরাঙ্গীর চরে ধর্ষণের শিকার এক নারীর উদাহরণ তুলে ধরা হয়। বছর তিনেক আগে তিনি ধর্ষণের শিকার হয়ে প্রথমে ঢামেক হাসপাতালের ওসিসিতে যান। পরে ওসিসির চিকিৎসকদের পরামর্শে থানায় যান। থানা তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, পরে তাকে একজন রাজনৈতিক নেতাকে সঙ্গে নিয়ে থানায় আসার নির্দেশ দেয় পুলিশ। বারবার অনুরোধের পর থানা মামলাটি নিতে রাজি হয়। এ বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘থানা পুলিশ মানুষের পকেট কাটতে যত ধরনের হয়রানি দরকার, সবই করে।’

জানা যায়, গত ১ মার্চ মিরপুর ১ নম্বরের চাইনিজ এলাকায় এক রিকশাযাত্রীর মোবাইল ফোন থাবা মেরে নিয়ে পালিয়ে যায় মোটরসাইকেলে থাকা দুই ছিনতাইকারী। ওই ঘটনায়ও থানা পুলিশ মামলা নেয়নি। মিরপুর মডেল থানা পুলিশ ছিনতাইয়ের ঘটনা আড়ালে রেখে তাকে হারিয়ে গেছে বলে জিডি করতে বাধ্য করে। মতিঝিল ও মিরপুর থানায় পৃথক দুটি জিডিতে উল্লেখ করা হয়- মোবাইল ফোন রাস্তায় হারিয়ে গেছে। অথচ দুটি ফোনই দিনের আলোয় ছিনিয়ে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ৭ মার্চ রাত দেড়টায় হাতিরঝিল রাস্তাসংলগ্ন মেরুল বাড্ডায় ছিনতাইয়ের শিকার হন নোমান ছিদ্দিক নামে এক তরুণ। এ ঘটনায় তিনি বাড্ডা থানায় মামলা করতে গেলে তাকেও জিডি করতে বাধ্য করে।

সর্বশেষ খবর